আজ গানের জগতে বড় প্রয়োজন মদন মোহনকে 

রাগসঙ্গীত থেকে ভজন এবং নানা ধরনের মেলোডি নির্ভর গানে দক্ষতার পরিচয় তিন দশক ধরে দিয়ে গিয়েছেন মদনমোহন। হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাথে ছিল তাঁর নাড়ির যোগ। তাঁর এই হিন্দি গানের সম্ভারে দেশি ও বিদেশি সুরের নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং বাণিজ্যিক সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাঁর বিভিন্ন ধরনের গবেষণাধর্মী ভাবনা-চিন্তার প্রয়োগ পরম্পরা উদ্বেল করেছিল ভারতবাসীর মন। গোটা পঞ্চাশ, ষাট বা সত্তর দশকে নিজের সৃষ্ট সঙ্গীতে মদনমোহন তুলে ধরেছিলেন তাঁর স্বকীয়তাকে।
একটা নির্দিষ্ট ধারার গানের ক্ষুদ্র সত্তায় নিজেকে আবদ্ধ করে রাখার কোনও আগ্রহ ছিল না তাঁর। আর সেই কারণেই তাঁর প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই ফুটে উঠেছিল নব নির্মাণের আনন্দ। গানের মধ্যে অর্কেস্ট্রার ব্যবহারকে এক অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শুধু মূল গান নয়, সেইসঙ্গে প্রিলিউড এবং ইন্টারলিউডের পর্বগুলিতে যন্ত্রসঙ্গীতের ব্যবহারে সুরসংযোজনার ক্ষেত্রেও ছিল তাঁর অসাধারণ মুন্সিয়ানা।
তবে এটা মানতেই হবে সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর আর মদনমোহন জুটি হিন্দি গানকে নিয়ে গেছে এক ভিন্ন উচ্চতায়। যেখানে এই জুটি শ্রোতাদের উপহার দিয়েছিল অজস্র গজল, রাগাশ্রয়ী আর সুরেলা গান। যেমন, ১৯৬২-র ‘অনপড়’ ছবির ‘আপ কি নজর নে সমঝা প্যায়ার কে কাবিল মুঝে’ গানটি। মালা সিনহার ঠোঁটে এই গান মদনমোহনের অমর সৃষ্টি। আর লতার যে গান শুনে স্বয়ং নৌসাদ সাহেব বলেছিলেন, তিনি তাঁর সব গান দিয়ে দিতে রাজি। বদলে এই গানটি তাঁর চাই! ১৯৬৬-তে মুক্তি পেয়েছিল সুনীল দত্ত আর সাধনা অভিনীত ‘মেরা সায়া’। সেই ছবিতে মদনমোহন-লতা জুটির উপহার চিরস্মরণীয় গান, ‘তু জহাঁ জহাঁ চলেগা, মেরা সায়া সাথ হোগা’। সেই গান আজও ভারতের বহু মোবাইলের রিং টোন। যেমন ভোলা সম্ভব নয়, ১৯৭৫-এ মুক্তি পাওয়া ‘মৌসম’ ছবির গান ‘দিল ঢুঁনঢতা হ্যায় ফির ওহি’। গুলজারের লেখা গানে সুর দিয়েছিলেন মদনমোহন। এই গানে লতাজির সঙ্গী ছিলেন ভূপিন্দর সিংহ। অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীব কুমার-শর্মিলা ঠাকুর। যে গান শুনে ও. পি. নায়ার ধন্দে পড়ে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কার প্রশংসা করব! মদনমোহন না লতার? দু’জনেই তাঁর সেরাটা দিয়েছেন। ফলে, এই গান কার সার্থক সৃষ্টি বলা বড় মুশকিল।’ তালিকায় আরও আছে। ‘নয়না বরসে রিমঝিম রিমঝিম’(ওহ কৌন থি, ১৯৬৪) বা ভীমপলশ্রী রাগে রচিত ‘নয়নো মে বদরা ছায়ে’ কিংবা কইফি আজমির লেখা ‘তেরি সাথ মেরি ওয়াফা’ (হিন্দুস্তান কি কসম, ১৯৭৩)-র মতো গানগুলো কোনও দিন পুরনো হবে না। যে গানের ক্যানভাসে আঁকা হয়েছে এক ব্যথা, এক বিরহের ছবি। হিন্দি গানের জগতে ভাগ্যিস মদনমোহন জুটি বেঁধেছিলেন লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে! লতা-মদনমোহন জুটির ২২৭ টি গানে আমরা পেয়েছি মন কেড়ে নেওয়া অসাধারণ মেলোডি। বেস গিটার, স্ট্রিংস, পিয়ানো, ঢোলক ও ঘটম সম্বলিত গানের দীর্ঘ তালিকার একেবারে প্রথম দিকে রাথতেই হবে, ‘হমারে বাদ অব ম্যাহফিল মেঁ’ (বাগী, ১৯৫৩), ‘মেরে পিয়া সে কোই যা কে’ (আশিয়ানা, ১৯৫২), ‘বড়ি বরবাদিয়াঁ লে কর’ (ধুন, ১৯৫৩), ‘কাল জ্বলেগা চাঁদ সারি রাত’ (নির্মোহি, ১৯৫২), ‘চাঁদ মধ্যম হ্যায় আসমান চুপ হ্যায়’ (রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম, ১৯৫৫), ‘কহে জিয়া কি উমঙ্গ ছায়ে’ (অ্যহসান, ১৯৫৪), ‘চল দিয়া দিল মেরা তোড় কে’ (ফিফটি-ফিফটি, ১৯৫৬), ‘ছোড় মুঝে না জানা’ (মদহোশ, ১৯৫১)-এর মতো বেশ কয়েকটি গানও।
পুরুষ গায়কদের মধ্যে মহম্মদ রফির গায়কী বিশেষ পছন্দ করতেন সুরকার মদনমোহন। মদনমোহন আর মহম্মদ রফির অমর জুটি শুরু হয় ১৯৫০ সালের ‘আঁখে’ থেকে। ‘হাম ইশক্ মেঁ বরবাদ হ্যায়ঁ, বরবাদ রহেঙ্গে’ গানটি লিখেছিলেন প্রখ্যাত গীতিকবি রাজা মেহেদি আলি খান। মজার কথা, এই ছবিতে স্বয়ং মদনমোহন একটি দ্বৈত গান পরিবেশন করেন শামশাদ বেগমের সাথে। কোরাস সহ একটি চমৎকার আলেখ্য পেশ করেছিলেন পরবর্তীকালের নামজাদা পরিচালক, রাজ খোসলা। মহেশ কৌল নির্দেশিত ‘আখরি দাও’ ছবিতে রফি কণ্ঠ নিঃসৃত মজরুহ-র লেখা ‘তুঝে ক্যয়া সুনাউঁ ম্যায় দিলরুবা’ এক অনবদ্য শৈল্পিক সৃষ্টি। রফি ও আশার ডুয়েট ‘জমিঁ সে হামেঁ আসমাঁ পর বিঠা কে গিরা তো না দোগে’, গানটি ‘আদালত’ ফিল্মটিকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দেয়। প্রমোদ চক্রবর্তী পরিচালিত ‘সংযোগ’ ছবিতে ‘দো ঘুটঁ চাহে পি অউর স্যয়ের দুনিয়া কি’,-ও হিন্দি গানের জগতে এক অসাধারণ সংযোজন। কিশোরকুমারের সঙ্গেও মদন মোহনের অসাধারণ মেলবন্ধনে আমরা পেয়েছি বেশ কিছু চমকপ্রদ সংগীত সম্ভার। যার মধ্যে অবশ্যই থাকবে ‘আশিয়ানা’, ‘ইলজাম’, ‘মাস্তানা’, ‘ভাই-ভাই’, ‘মেম সাহিব’, ‘চাচা জিন্দাবাদ’, ‘মনমৌজি’, ‘লড়কা লড়কি’, ‘পারওয়ানা’, ‘এক মুঠ্ঠি আসমান’, ‘সাহিব বাহাদুর’, ‘রেহনুমা’ ফিল্মের গানগুলি। এছাড়াও মুকেশ, মান্না দে, হেমন্তকুমারকেও চমৎকার ভাবে ব্যবহার করেছেন মদন মোহন তাঁর ছবিতে।
এরপর ‘বীরজারা’ ছবিতেই মদন মোহনের সুর শেষবারের মত শুনেছেন শ্রোতারা। তাঁর সেরার তালিকায় অবশ্যই থাকবে ‘ঝুমকা গিরা রে’, ‘লাগজা গলে’, ‘আপকি নজরো নে’, ‘তুম যো মিল গয়ে হো’, ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মহফিল’,  ‘রুকে রুকে সে কদম’, ‘নয়না বরসে রিমঝিম’, ‘খেল না মেরে দিলসে’, ‘জরা সি আহাট হতি হ্যায়’-এর মতো বেশ কিছু গান। তাঁর মতো কিংবদন্তি সুরকারের মৃত্যু হয় না। তিনি তাঁর গানে অমর, অক্ষয়। বারেবারেই মনে হয়, মদন মোহনের মতো অবিস্মরণীয় সুরশিল্পীদের অন্তর থেকে ঝরে পড়া সুরের আজ বড় প্রয়োজন ভারতীয় সঙ্গীতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 + thirteen =