কসবা কাণ্ডে ধৃত মনোজিৎ সাউথ ক্যালকাটা ল‘কলেজের প্রাক্তন ছাত্র, এমনটাই জানা গিয়েছিল শুক্রবার। সঙ্গে এও জানা গিয়েছিল কলেজের ইউনিটের প্রাক্তন সভাপতি, বর্তমানে ওই কলেজেরই অস্থায়ী কর্মীও সে। সঙ্গে এও জানা গেছে, বছর ৩১–এর মনোজিৎ একসময়ের ছাত্র রাজনীতির জনপ্রিয় মুখ। মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার থেকে আসা মনোজিৎ এই কলেজ থেকেই তৃণমূল কংগ্রেস ছাত্র পরিষদের হাত ধরে রাজনীতির হাতে খড়ি শুরু। এরপর মনোজিত প্রায় এক দশক ধরে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। সময়ের সঙ্গে সে কলেজ ক্যাম্পাসে ‘ক্ষমতার কেন্দ্র‘ হয়ে ওঠে। অতীতেও ইউনিয়ন বিরোধের সময় তার বিরুদ্ধে চাপ এবং হুমকির অভিযোগ উঠেছে। তবে তার বিরুদ্ধে পুলিশি কোনও অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। সূত্রে খবর, তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে সবাই এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এড়িয়েও চলতেন। এই মনোজিৎ সম্পর্কে একটু খোঁজখবর করতেই সামনে এল বিস্ফোরক সব তথ্য। কেবলমাত্র বুধবারের ধর্ষণ কাণ্ড–ই নয়, এর আগেও একাধিকবার যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে এইমনোজিতেরবিরুদ্ধে।কিন্তু এক অদৃশ্য কারণে মনোজিতের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করতে পারেনি পুলিশ প্রশাসন।
এদিকে বুধবারের এই ঘটনার পর সাউথ ক্যালকাটা ল‘কলেজে প্রবেশ করতেই নজরে পড়ে বিভিন্ন দেওয়ালে নীল–সাদা রঙে লেখা ‘টিম এমএম‘। কোথাও আবার চোখে পড়বে ‘মনোজিৎ দাদা তুমি আমাদের হৃদয়ে আছ‘। সব জায়গাতেই লেখা, ‘দক্ষিণ কলকাতা তৃণমূল কংগ্রেস‘। এছাড়াও মিলেছে মনোজিৎ সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য। ঘনিষ্ঠ মহলে এই মনোজিৎ পরিচিত ‘ম্যাঙ্গো‘ নামে। এ ছাড়াও কলেজ পড়ুয়ারা এও জানান, ভর্তি থেকে শুরু করে কলেজ ইউনিয়নের কে কোন পদে বসবেন, সবই চলত মনোজিতের ইচ্ছের উপর। এমনকী, অনেক সময়েই কোন শিক্ষক কখন–কোন ক্লাস নেবে, তা–ও অনেক সময়ে ঠিক করে দিত এই ম্যাঙ্গোই। কলেজের কর্মী থেকে অধ্যক্ষ, সবাই নাকি থাকত তার হাতের মুঠোয়। কোন শিক্ষককে ঘেরাও করা হবে, কার গাড়ি ভাঙচুর করা হবে, তা–ও হত ম্যাঙ্গোর ইশারাতেই। এমনটাই জানা গিয়েছে কলেজ পড়ুয়াদের সূত্রে।
শুধু তাই নয়, কালীঘাট মন্দির চত্বরে বাড়ি মনোজিৎ মিশ্রর প্রবল দাপট। তার দাপটে নাকি পাড়ার লোকও সিঁটিয়ে থাকেন। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২ সালে প্রথমবার কলেজে ভর্তি হয়েছিল সে। এক বছরের মধ্যে কলেজে ছুরি মারার অভিযোগে থানায় অভিযোগ দায়ের হয় তার নামে। তারপর দীর্ঘ কয়েক বছর কলেজ যায়নি সে। এরপর ২০১৪ সালে তাকে ডিসকলেজিয়েট করে দেওয়া হয়। এদিকে এও জানা যাচ্ছে, প্রথম থেকেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদ করতো এই মনোজিৎ। ছিল ইউনিট প্রেসিডেন্টও। তারপর ২০১৭ সালে ফের সাউথ ক্যালকাটা ল‘কলেজে ভর্তি হয় ম্যাঙ্গো। সে বছরই সিসিটিভি ভাঙচুরের ঘটনায় নাম জড়ায় তার। একাধিকবার সাসপেন্ডও করা হয় মনোজিৎকে। সূত্রের খবর, ওই কলেজের প্রয়াত প্রিন্সিপাল দেবাশিস চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তারও করা হয় তাকে। ২০২১ সালে পাশ করলেও কলেজ ছেড়ে যায়নি। একাধিক ঝামেলা–গোলমালে নাম জড়িয়েছে তার।এই কলেজেএকচ্ছত্রক্ষমতাদখলকরেবসেছিলসে।তৃণমূলের প্রথম সারির নেতাদের সঙ্গে তার ছবি দেখিয়ে জুনিয়রদের ওপর প্রভাব খাটাতো।কলেজ এবং বাইরের একাধিক তরুণীকে হেনস্থা ও উত্যক্ত করার অভিযোগও রয়েছে এই মনোজিতের নামে।
আর এই ধরনের যে সব অভিযোগ মনোজিতের বিরুদ্ধে উঠছে তা যে সত্য তার প্রমাণ মিলেছে কালীঘাট এলাকার তথা ৮৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের কথায়। প্রবীরবাবু স্পষ্ট জানান, এলাকায় নানা ঘটনায় দুর্নাম ছিল এই মনোজিতের। আর সেই কারণে তিনি তাঁর এলাকায় দলের কাজে ওকে ঢুকতে দিতেন না। একইসঙ্গে প্রবীরবাবু এও জানান, মনোজিতের নামে নানা অভিযোগ নিয়ে এলাকার বাসিন্দারা বারবার এসেছেন তাঁর কাছে। এমনকী দলের নাম করেই ওই ‘গুণধর’ এলাকায় অনেক কুকাজ করেছেন দীর্ঘদিন থেকে। আর এই ঘটনারই রেশ টেনে তিনি এও বলেন, ‘দলের নাম কাজে লাগিয়ে এলাকায় অনেক কাজ করেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম, দলের জন্য এই ছেলেটা খারাপ।’ সঙ্গে এও জানান, ‘ চিনতাম না, এটা বলব না। কারণ আমি ওকে এলাকায় নয় কিন্তু এলাকার বাইরে অনেক দলীয় কর্মসূচিতে দেখেছি। সাধারণ মানুষ একাধিক অভিযোগ করতো বলে, আমি ওর সঙ্গে মিশতাম না। কিন্তু কেউ যদি আমার কাছে এসে পিছনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে, তাহলে আমি কী করে বুঝব তার ব্যক্তিগত বা মানসিকতায় কি রয়েছে।’ এর পাশাপাশি ৮৩ নম্বর ওয়ার্ডের
এলাকার বাসিন্দাদেরও অভিযোগের অন্ত নেই এই মনোজিতের বিরুদ্ধে। তাঁরা জানান, আগেও একাধিক বিষয় নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে ওই যুবক। কারও কথাই নাকি শুনত না। সকালে মিষ্টি কথা বলতো। বিকেলে সম্পূর্ণ বিপরীত। মুখের ভাষা থেকে অন্যান্য বিষয়ে মনোজিতের সঙ্গে কথা বলা যেত না।
এদিকে মনোজিতের সঙ্গে পুলিশের জালে ধরা পড়েছে জইবও। এই জইব তপসিয়া এলাকার বাসিন্দা, একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। ২০২৪–২৫ শিক্ষাবর্ষে কলেজে ভর্তি হয়। এরপর কলেজে ধীরে ধীরে ইউনিয়নে যোগ দেয়। সহপাঠীরা জানান, জইব শান্ত স্বভাবের। তবে সহজেই প্রভাবিত হয়ে যায়। তার কোনও অপরাধমূলক রেকর্ড নেই।তার বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক সতর্কীকরণও নথিভুক্ত করা হয়নি। সহপাঠীদের ধারনা, ইউনিয়ন করতে গিয়েই মনোজিতের সঙ্গে তার দেখা হয় এবং ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। এছড়াও এই ধর্ষণ কাণ্ডে গ্রেপ্তার করা হয়েছে প্রমিত মুখোপাধ্যায়কেও। প্রমিতের বয়স ২০ বছর। অন্য দুই অভিযুক্তের তুলনায় প্রমিত কলেজ রাজনীতিতে অতটা সক্রিয় নন। তবে সে ছাত্রদের একটি নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। নিম্ন–মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার থেকে আসা প্রমিতকে তার বন্ধুরা ‘শান্ত প্রকৃতির ছেলে‘ হিসেবেই চেনে। এই ঘটনার আগে তার কোনও অপরাধমূলক রেকর্ড ছিল না।আর এই সব কারণেই পুলিশ জানার চেষ্টা করছে, এই মামলায় তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল নাকি সে কোনও চাপের ফলে এই ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে।