‘প্রথা’র আক্ষরিক অর্থ হল কোনও ঘটনাকে কেন্দ্র করে আমরা যে পদ্ধতি দীর্ঘকাল ধরে মেনে আসছি। এই সব প্রথাকে ঘিরে গড়ে ওঠে কোনও জাতির সংস্কৃতিও। আবার এটাও ঠিক, কোনও জায়গার সংস্কৃতির ওপর সব থেকে বেশি ছাপ ফেলে সেখানকার কৃষি। সেক্ষেত্রে ভারতও ব্য়তিক্রম নয়। এখানকার বহুজাতিক সংস্কৃতিতেও কৃষিজ পণ্যের মধ্যে প্রধান ধান-ই সবথেকে বেশি ছাপ ফেলেছে আমাদের সংস্কৃতিতে। এই ধানকে ঘিরেই ভারতে বিভিন্ন সংস্কৃতিকে রয়েছে নানা উৎসব। যেমন বাংলার ক্ষেত্রে ‘নবান্ন’, অসমের ক্ষেত্রে ‘বিহু’, এমন আরও অনেক কিছুই। এই ধান ভারতীয় অর্থনীতির মেরুদণ্ডও বটে। অন্যদিকে সংস্কৃতির একটা বড় অংশ লোকসংস্কৃতি । ফলে লোকসংস্কৃতির সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে এই ধান-ই।
এদিকে আমরা যে প্রতিদিন নানা কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ি তার পিছনে রয়েছে খাদ্য, বস্ত্র এবং বাসস্থানের চাহিদা। সেক্ষেত্রে ‘নবান্ন’ উৎসবের মধ্য দিয়েই শুরু হচ্ছে আমাদের জীবনের পথচলা। সেক্ষেত্রে ধান-কে বাদ দিয়ে আমাদের জীবন ধারন একেবারেই অসম্ভব। আর এই ধান যাঁদের হাত দিয়ে বাজারে আসে তাঁরাই তো আদতে ভারতীয় অর্থনীতির মূল কারিগর। অথচ এই কৃষকদের অবদান আমরা ভুলতে বসেছি। ভুলতে বসেছি ‘নবান্ন’কেও। তবে শহুরে জীবন ছেড়ে একটু গ্রামের দিকে গেলে এখনও সমগ্র বাংলা মেতে ওঠে ‘নবান্ন’ উৎসব ঘিরে। এই নবান্ন উৎসবও একটা প্রথাও বটে। আর সেই কারণেই উত্তর কলকাতার সংঘতীর্থের পুজোর মূল থিম ‘প্রথা’ হলেও তারই মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে ‘নবান্ন’। এই থিমের মধ্যে দিয়ে পুজোর উদ্যোক্তারা আধুনিক প্রজন্মকে বার্তা দিতে চান, প্রযুক্তির গোলকধাঁধায় নিজেদের হারিয়ে ফেললেও কোনও ভাবেই ভুললে চলবে না আমাদের শিকড়কে।
তবে লাহা কলোনির মাঠে সংঘতীর্থের এই পুজো কিন্তু আজকের নয়। দেখতে দেখতে এই পুজো পার করেছে ৫৭ বছর। এবার পা দিল ৫৮-তে। এখানে আরও একটা কথা বলতেই হয়, তা হল সনাতনী ঢংয়ে দীর্ঘকাল পুজো হয়ে এলেও গত বছর থেকে ভাবনা-চিন্তায় বদল এনে শুরু হয় থিম পুজো। ২০২২-এর থিম পুজো বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়। ফলে ২০২৩-এও কোনও বিশেষ থিমের ওপরেই পুজো হবে বলে সিদ্ধান্ত নেন সংঘতীর্থের পুজো উদ্যোক্তারা। ২০২২-এ থিম পুজোর দায়িত্বে ছিলেন শঙ্কর পাল। এ বছরও দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে তাঁরই হাতে। শঙ্কর পালের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে মায়ের মূর্তি গড়েছেন সৌমেন পাল।
শঙ্করবাবুর হাতের ছোঁয়াতেই লাহা কলোনির মাঠ পুজোর কয়েকদিন রূপ নেবে গ্রামের এক শস্য ভাণ্ডারের বা ধানের গোলার। কোনও প্রান্তিক গ্রামে যেখানে এখনও আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি সেই সব জায়গায় এখনও নজরে আসে এই মাটির তৈরি ধানের গোলা তারই আদলে বানানো হচ্ছে মণ্ডপ। এদিকে শস্যের দেবী হিসেবে বাঙালি চিরকালই আরাধনা করে আসছে মা অন্নপূর্ণার, যা দেবী দুর্গারই অপর এক রূপ। এই অন্নপূর্ণাই অধিষ্ঠিত থাকছেন এই গোলার মধ্য়ে এক সিংহাসনে। এখানে মাতৃমূর্তি ঠিক রণংদেহি রূপে অধিষ্ঠিত নন, বরং তিনি অনেক বেশ পরিস্ফুট অন্নদাত্রী রূপে। গ্রামবাংলার ঘরের মা বা মেয়ে ঠিক যেমন রূপে ধরা দেন ঠিক তেমনভাবেই মাকে গড়ে তুলছেন শিল্পী সৌমেন। প্যান্ডেল পুরোটাই খড়, বাঁশ আর মাটি দিয়ে তৈরি। গ্রাম বাংলার ধান গোলার সেই আবহকে ফুটিয়ে তুলতে বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি দেখা যাবে না মণ্ডপে। বরং সেখানে রয়েছে হাজারো প্রদীপের অবস্থান। নরম এক আলো-আঁধারির পরিবেশে মা দুর্গা বিরাজ করবেন অন্নদাত্রী হিসেবে। তারই সঙ্গে খুব হাল্কা সুরে শোনা যাবে এই থিমের সঙ্গে মানানসই এক সুর, যা তৈরি হয়েছে শিল্পী সৈকত দেবের চিন্তনে। পুজো মণ্ডপ চত্বরের দিকে এগোতে থাকার পথে গ্রাম বাংলায় নবান্ন-র ধাঁচে দেওয়া থাকবে আল্পনা। সেই পথ ধরে এগিয়ে গেলেই পুজো মণ্ডপে প্রবেশের মুখে নজরে আসবে ‘লাঙ্গল’, ‘কুনকে’, শস্য কাটার কাঁচি এমনই সব কিছু যা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে বসেছে আধুনিক প্রজন্মের কাছে। শুধু তাই নয়, সমগ্র পুজো মণ্ডপ জুড়ে কৃষি জমির একটা বাতাবরণ তৈরি করতে ধান রোপন করেও। এককথায়, সংঘতীর্থের যে পুজোকে একদা উত্তর কলকাতার ম্যাডক্স স্কোয়ারের পুজো বলে অভিহিত করা যেত, সেই আবহকে একটু দূরে সরিয়ে রেখে গ্রাম বাংলাই যেন এবার একটু বেশি প্রাধান্য পেল সংঘতীর্থের পুজোয়।