নির্মলার ধোঁয়াটে বাজেট!

নির্বাচনী বছরে যতই বাজেটের চরিত্র ‘অন্তর্বর্তী’ হোক না কেন, প্রত্যেক শাসকেরই উদ্দেশ্য থাকে ভোটমুখী বা বেশ কিছু মনোমোহিনী ঘোষণার। যার মাধ্যমে নির্বাচক জনসংখ্যাকে প্রভাবিত করা যায়। দ্বিতীয় মোদি সরকারের এই শেষ বাজেটেও তার অন্যথা হয়নি। ঢাকঢোল পিটিয়ে অর্থমন্ত্রীকে রাজনৈতিক ভাষণের ঢংয়েই সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রশস্তি গাইতে দেখা গেছে। রামমন্দির উদ্বোধনের কথার উল্লেখের পাশাপাশি জানিয়েছেন এই বাজেটের মাধ্যমে সরকারের প্রধান লক্ষ্যই হল সুশাসন, উন্নয়ন ও কার্যক্ষেত্রে ব্যবহারিক ফলাফলকে সুনিশ্চিত করা। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই গেছে সমস্ত অঙ্কের হিসেবের নিরিখে এই বাজেট আশাপূরণের বাজেট নাকি এই বাজেটের আড়ালেও লুকিয়ে রইল মিথ্যা প্রতিশ্রুতিই!

বক্তব্যে বলা হল, মোদি সরকারের উদ্দেশ্যই হল গরিব, যুবা, মহিলা ও কৃষকদের উন্নয়ন। অন্তর্বর্তী বাজেটের পরিসংখ্যান কি সেই উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিকে আদৌ সমর্থন করছে কিনা দেখা যাক। দেশের জিডিপি বাড়ানোর অন্যতম একটি কৌশল হচ্ছে দেশের তরফে মূল ব্যয় অথবা ক্যাপেক্সের পরিমাণ বাড়ানো। দেশ যদি অধিক ব্যয় করতে সক্ষম হয়ে, সেই সূচকই জিডিপি-বৃদ্ধির সঙ্গে তত্ত্বগতভাবে সমানুপাতিক বলে মনে করা হয়ে থাকে। সেই কারণেই, বিগত অর্থবর্ষের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে মোদি-সরকারের তরফে ক্যাপেক্সের পরিমাণ ১১.১ শতাংশ বাড়িয়ে ১১ লক্ষ কোটি টাকারও উপরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিগত অর্থবর্ষে প্রস্তাবিত ক্যাপেক্সের পরিমাণ ছিল ১০ লক্ষ কোটি টাকা। কিন্তু যে-মুহূর্তে এই বিপুল ব্যয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চিতভাবেই সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণও ক্রমশই বাড়তে থাকবে। তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়বে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ। অর্থাৎ সহজ করে বললে সরকারের আয় ও ব্যয়ের যে অন্তর, তা ক্রমশই বেড়ে চলতে থাকবে।

এখন বিশেষ যে ক্ষেত্রগুলিতে ব্যয়বরাদ্দ কমানো হয়েছিল, সেগুলিকেই বরং লক্ষ করা যাক। শিক্ষাক্ষেত্রে ১.১৬ লক্ষ কোটি টাকার ব্যয়বরাদ্দ থাকলেও, বাস্তবে খরচ করা হয় মাত্র ১.০৮ লক্ষ কোটি টাকা। চলতি অন্তর্বর্তী বাজেটে শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যয় আরও ৯,৬০০ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, এবং এই বাজেট-হ্রাসের সবটুকুই হয়েছে উচ্চশিক্ষার ব্যয়বরাদ্দতেই। দলিত, উপজাতি ও সংখ্যালঘু মানুষদের উন্নয়নের জন্য বাজেট বরাদ্দ ধরা হয়েছিল ৯,৪০৯ কোটি টাকা। কার্যক্ষেত্রে সেখানে খরচ করা হয়েছে মাত্র ৬,৭৮০ কোটি টাকা। আরও খতিয়ে দেখলে জনজাতিদের জন্য বরাদ্দ ৪,২৯৫ কোটি টাকার মধ্যে ৩,২৮৬ কোটি টাকা মাত্র খরচ করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ ৬১০ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৫৫৫ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। কাজেই, ক্যাপেক্স বাড়াতে চাইলেও যে-কোনও কারণেই হোক সেই লক্ষ্যমাত্রা ছুঁতে অথবা ততখানি পরিমাণ অর্থ খরচ করে দেখাতে মোদি-সীতারামণের সরকার এখনও অবধি ব্যর্থ। এখানেই শেষ নয়, মনরেগা অথবা ১০০ দিনের কাজ, গ্রামীণ কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিগত বছর অবধি ক্রমাগতই সেই খাতে মোদি সরকার ব্যয়বরাদ্দ কমিয়ে এসেছে।

এদিকে এই কৃষকদরদি সরকারের গত ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে কৃষিক্ষেত্রে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১,৪৪,২১৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার খরচ করতে পেরেছে ১,৪০,০৩৩ কোটি টাকা, এবং বরাদ্দ আরও কমিয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে কৃষিক্ষেত্রে ব্যয় ধার্য করা হয়েছে ১,২৭, ৪৬৯ কোটি টাকা। সারের ভর্তুকি হিসেবে বিগত বছরের বাজেট বরাদ্দ ছিল ১,৮৯,০০০ কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অন্তর্বর্তী বাজেটে সেই বরাদ্দ এক কোপে ৩০,০০০ কোটি টাকা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি, গরিব দরদি সরকারের ২০২৩-২৪ সালে গরিব মানুষের খাদ্যের প্রয়োজনে ব্যয়বরাদ্দ ছিল ২,১২,৩৩২ কোটি টাকা। চলতি বছরে সেই ব্যয়বরাদ্দ কমে দাঁড়িয়েছে ২,০৫,২৫০ কোটি টাকা। এর বিপরীতে কর্পোরেট মুনাফার উপর ট্যাক্সের পরিমাণ ছিল ৩০ শতাংশ। এখন সেই পরিমাণ কমিয়ে ২২ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়াও নতুন উৎপাদন শিল্পে কর্পোরেট মুনাফার উপর ট্যাক্সের হার আরও কমিয়ে রাখা হয়েছে মাত্র ১৫ শতাংশ।

বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন বিগত এক দশক দেশের সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় ৫০ শতাংশ হারে বেড়েছে। অথচ মোদি সরকারেরই পরিসংখ্যান দফতরের তরফে প্রকাশিত ‘পিরিওডিক লেবার ফোর্স সার্ভে’ অথবা ‘পিএফএসও’ রিপোর্ট অনুসারে দেখা যাচ্ছে, ২০২০-২১ সালে যেখানে বিনা মজুরির শ্রমিক ছিল দেশের মোট শ্রমিক সংখ্যার ১৭.৩ শতাংশ, ২১-২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭.৫ শতাংশে এবং ২২-২৩ অর্থবর্ষের হিসেব অনুযায়ী সেই সংখ্যা এখন মোট শ্রমিক সংখ্যার ১৮.৫ শতাংশ। এভাবে বিনা মজুরির শ্রমিকসংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার পরেও কোন জাদুমন্ত্রে দেশের মানুষের গড় আয় ৫০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেল তা স্পষ্ট নয়। এরই পাশাপাশি স্বনির্ভর শ্রমিকদের সংখ্যাও এদেশে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। স্বনির্ভর অর্থে যারা ছোট খাবারের দোকান চালায়, মুটে, মজুর, হকার, ঠেলাচালক, রিকশাচালক, ক্ষৌরকার, এই গোত্রের আওতায় পড়েন। আইএলও বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনের নিয়ম অনুসারে বিনা মজুরির শ্রমিক অথবা এমন স্বনির্ভর শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবেই গণ্য করা হয় না। গণ্য করলেও, তথ্য বলছে ২০১৭-১৮ সাল থেকে আজ অবধি দেশে স্বনির্ভর শ্রমিকের সংখ্যা মোট শ্রমজীবী মানুষের ৫২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৬০ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পরবর্তীতেও বাজেট ভাষণে অর্থমন্ত্রী  ৫০ শতাংশ আয়বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করেছেন। বার সাতেক কর্মসংস্থান শব্দটি উচ্চারণ করলেও ধোঁয়াটে প্রতিশ্রুতি ছাড়া আর কিছুই উল্লেখিত হয়নি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × 1 =