বিজেপির পাকা গুটি কাঁচাতে পারেন অন্নদাতারাই

শুভাশিস বিশ্বাস

 

স্বাধীনতার পরে মধ্য চাষি বা প্রান্তিক চাষিরা কিছু আন্দোলন করেছিলেন। তেভাগা আন্দোলন। পরবর্তীতে নকশালবাড়ির লড়াই। তবে তা ছিল কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে। ১৯৮৮- তে অক্টোবর নভেম্বর মাসে মহেন্দ্র সিং টিকায়েতের নেতৃত্বে, কম বেশি সম্পন্ন কৃষকেরা, এইভাবেই দিল্লিতে এসেছিল। নরেন্দ্র মোদি, রবিশঙ্কর প্রসাদেরা সম্ভবত এই আন্দোলনের কথা হয়তো ভুলে গেছেন। আজকের নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়েও সেই সময়ে সরকারের প্রধান, রাজীব গান্ধির কাছে ছিল ৪০৪ জন সাংসদ। মানে এখনকার বিজেপির থেকে অন্তত ১০০ জন বেশি এমপি, সেই সময় মিডিয়া বলতে খবরের কাগজ আর দূরদর্শন, তারপরেও টিকায়েতের ডাকা ‘দিল্লি চলো’তে রাজধানীর সর্বত্র সেদিন কৃষকেরাই ছিল। বোট ক্লাব থেকে রাজপথ, ইন্ডিয়া গেটে কেবল কৃষক, কেউ কেউ বড় বড় হুক্কা নিয়ে রাজপথেই বসেন। সেদিন তাঁদের দিল্লি ঢোকার আগে রাস্তা কেটে দেওয়া হয়নি, জলকামানও ছোড়া হয়নি। তাদেরকে মাওবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলেও তকমা লাগানো হয়নি। তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল, কিছু সমস্যার সমাধান হয়েছিল, শেষে কৃষক নেতা টিকায়েত আন্দোলন ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, কৃষকরা ঘরে ফিরেছিলেন। ৩৫টা দাবি, আখের আরও বেশি সহায়ক মূল্য, বিদ্যুৎ ভর্তুকি, সেচে ভর্তুকি মেনে নিয়েছিল সরকার, মানে মানতে বাধ্য হয়েছিল।
ফলে এই কৃষক আন্দোলন যে পর্যায়ে গেছে, তাতে করে ওসব মাওবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে এই আন্দোলনকে দমানো যাবে না, এ আন্দোলনের চেহারা আরও অনেক বড়। মনে হতেই পারে যে তারা ফিরে গেছে, আন্দোলন শেষ, কিন্তু এ আন্দোলন রাজনৈতিক নেতাদের মতো এমএলএ, সাংসদ হওয়ার আন্দোলন নয়। ভাতের লড়াই, জমির লড়াই, হকের লড়াই। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, বিজেপি সরকার কৃষক আন্দোলনের চাপে মাথা নত করে কৃষি বিল প্রত্যাহার করেছিল। ফলে জোরকদমে আন্দোলন হলে এমনকি মোদি সরকারও মানতে বাধ্য। ফলে সরকার বদল কৃষকের স্বার্থে অপরিহার্য নয়, যদি এমন ভাবনা মনে স্থান পায় তবে সেটা ভয়ানক বিপদের। বিজেপি গত বছর পিছু হঠেছে ঠিকই। কিন্তু ২০২৪ সালে ক্ষমতায় ফিরলে বিলটি ফেরত আনার সম্ভবনাই সবথেকে বেশি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের ধারনা, কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধি বিজেপির মতাদর্শ বা অ্যাজেন্ডা নয়। কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধি, কৃষির শিল্পায়ন তাদের মতাদর্শের ঠিক বিপরীত। আধুনিক কৃষিসমাজ তারা কল্পনাও করে না। কৃষককে কৃষি উৎপাদন থেকে সরিয়ে দাঙ্গাকারী, অগ্নিবীর সেনা, ইজরায়েলে যুদ্ধে পাঠাতে আগ্রহী হতেই পারেন মোদি। কৃষির সঙ্গে যুক্ত আজকের ভারতের ৫০-৫৫ শতাংশ মানুষকে ফ্যাসিবাদের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চান মোদি। কৃষিলবি যদি তাদের পক্ষে না দাঁড়ায় তবে তাদের যুগ ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য। আর বর্তমান ভারতের পঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষিলবি তাদের দিকে নেই। চৌধুরী চরণ সিংকে ভারতরত্ন দিলেও নেই। তাই দেশের হরিয়ানা পঞ্জাবের কৃষিলবির বদলে নতুন লবি গড়ে তুলতে হবে। যারা আদানির ভৃত্য হতে রাজি।যাঁরা মোদি-সার্টিফায়েড হিন্দুত্বের ফর্মুলায় কৃষিকাজে রাজি। উচ্চফলনশীল প্রক্রিয়ায় যুক্ত স্বাধীনচেতা কৃষকদের কোনঠাসা করতে হবে মোদিকে। এককথায় বললে এক নব্য জমিদার-জোতদারশ্রেণি গড়ে তোলা বিজেপির মূল উদ্দেশ্য। অন্যের জমি দখল করে জমিদারি সাম্রাজ্য গড়ে তোলাই যাদের কাজ এবং যে কাজে বর্তমানে সর্বস্বান্ত গরিব প্রান্তিক চাষিদের লোভ দেখিয়ে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পাবে এই নব্য জমিদারেরা।

এখানে নরেন্দ্র মোদির প্রথম সরকার বা দ্বিতীয় সরকারের, একটা প্রবণতা খুব উল্লেখযোগ্য। যে কোনও আন্দোলন একটু তীব্র হলেই সরকার নার্ভাস। সাংসদ ৩০৩, মন্ত্রী সব দফতরেরই বিজেপিরই। দলে ভাঙন নেই। বিরোধী দল এতটাই দুর্বল যা ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে কোনওদিন ছিল না। তবুও কোনও আন্দোলন একটু তীব্র হলেই সরকার নার্ভাস। তাদের বক্তব্য, তাদের ভাবভঙ্গি নার্ভাস, তার কারণ সামনে নির্বাচন, পাকা ঘুঁটি কাঁচিয়ে দিতেই পারে অন্নদাতাদের এই আন্দোলন। আন্দোলনটা পঞ্জাব বলেই আরও বেশি ভরসা, চেহারা আর মেজাজ জঙ্গি হতে সময় নেয় না, তার কিছু কারণ আছে। প্রথম কারণ হল, শিখ মানুষজন এমনিতে আমুদে, খাওয়াদাওয়া, পানভোজন, নাচগান ভালোবাসেন, এবং তার সবটাতেই প্রবল প্রাণপ্রাচুর্য। তাদের অনুভূতি আর তার প্রকাশ, সবসময়েই ওপরের তারে বাঁধা। আনন্দে নাচ বা গানে যতটা প্রাণ আছে, রাগের অনুভূতি প্রকাশে ততটাই উগ্রতা আছে। আর সেইকারণেই শিখরা নিজেদের একটা আলাদা কমিউনিটি হিসেবেই ভাবেন।

এদিকে বিজেপির চারটে অস্ত্র, এক, নরেন্দ্র মোদি, দুই, মেরুকরণ। তিন সংগঠন আর চার নম্বর অস্ত্র হল তীব্র দেশপ্রেমের বুলি, জঙ্গি জাতীয়তা বোধ। পঞ্জাবে এই চারটে অস্ত্রের মধ্যে তিনটেই কাজ করে না। পঞ্জাবে বিজেপির তেমন সংগঠন নেই, এতদিন তারা অকালি দলের পিঠে ভর করেই চলেছে। অকালি দলের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে তারা আরও নড়বড়ে। মেরুকরণ ওখানে নেই, কারণ শিখদের সঙ্গে মুসলমানদের ঝামেলা দেশভাগের সঙ্গেই শেষ হয়ে গেছে, পঞ্জাবে মুসলমানরা শিখদের কাছে থ্রেট নয়। আর ওই জাতীয়তাবাদের পাঠ শিখদের জন্মসূত্রে পাওয়া। এমন কোনও পরিবার নেই যে পরিবারে কেউ না কেউ আর্মিতে কাজ করেনি, ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ে অংশ নেয়নি। কাজেই উগ্র জাতীয়তাবাদের বুলি ওখানে চলবে না। ফলে নরেন্দ্র মোদি পঞ্জাবে বড়ই অসহায়। আর এই কারণেই পঞ্জাবে কৃষকদের আন্দোলন কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী এক আন্দোলনের রূপ নিচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

19 − 16 =