রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগপত্রে সই না করে ফেরত পাঠিয়েছেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। আর প্রশ্ন এখানেই, তাহলে কি নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগ বাতিল হয়ে গেল? আর নির্বাচন কমিশনারের নিয়োগই যদি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে তো নির্বাচন প্রক্রিয়াও বিশ বাঁও জলে। শুধু তাই নয়, নির্বাচন প্রক্রিয়াই তো তাহলে অবৈধ। এর অর্থ নির্বাচন বাতিল। সওয়া দু’ লক্ষ মনোনয়নও বাতিল। এরপর অন্য কাউকে নিয়োগ করা হবে। তিনি আবার দিনক্ষণ ঘোষণা করবেন। আবার মনোনয়ন দেওয়া হবে। মানে পুরো প্রক্রিয়াটাই তো ‘ব্যাক টু স্কোয়ান ওয়ান’। আমাদের রাজ্যে নির্বাচনে তো এটাই ট্র্যাডিশন, রক্ত ঝরে, মানুষ মরবে। এতো সব জমানায় ঘটেছে।ভোট লুঠের গল্পও আছে। তাহলে এই নতুন কমিশনার আসার পরে হঠাৎ সবকিছু রাতারাতি বদলে যাবে, এটাও কী সম্ভব! মনোনয়ন নিয়ে ঝামেলায় মৃত্যু হতেই পারে। তাহলে কি আবার নির্বাচন বাতিল হয়ে যাবে? তবে এই মুহূর্তে পুরো ঘটনা যে জায়াগায় দাঁড়িয়ে তাতে পঞ্চায়েত ভোট আদৌ হবে তো, এটা নিয়েই তৈরি হয়েছে ঘোর সংশয়। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্যই এই পঞ্চায়েতের ধারণার জন্ম তা নয়। আদতে ভারতবর্ষের গ্রামীণ সামাজিক ব্যবস্থার অঙ্গ হিসেবে ছিল গ্রামের পাঁচ অভিজ্ঞ, জ্ঞানী মানুষের এক সম্মিলনী। যেখানে মানুষ আসতেন নির্দেশ নিতে, সমস্যার সমাধান করতে। বহু পরে আমাদের গণতান্ত্রিক কাঠামোর এক্কেবারে তলার সারিতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রশাসনিক কাঠামো হয়ে দাঁড়াল আজকের এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। পশ্চিমবঙ্গে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয় বাম আমলে। এর কিছুদিন পরেই প্রত্যেক রাজনৈতিক দল বুঝতে পারে পঞ্চায়েত দখলে থাকলেই রাজ্য দখলে থাকবে। এরপর থেকেই পঞ্চায়েতের মাধ্যমে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাকে ঘিরে দলীয় আনুগত্য তৈরি হয় ওই বাম আমল থেকেই। এর নিট ফল, যাঁরা অনুগত নয় আর যাঁরা অনুগত তাঁদের মধ্যে বিরোধ বাধে। একসময় তা রক্তক্ষয়ী রূপ নেয়। এখানে একটাপরিসংখ্যান দিলেই ছবিটা স্পষ্ট হবে। ২০০৮-এ পঞ্চায়েত ভোটে ৭০ জনের বেশি মানুষ মারা যান। ২০০৩-এ ১১ শতাংশ আসনে কোনও নির্বাচন হয়নি। বাম জমানার অবসানের পরও এই বদলায়নি। বরং আমরা ২০১৮তে দেখেছিলাম ৩৪-৩৫ শতাংশ আসনে কোনও নির্বাচনই হয়নি। সেদিক থেকে বিচার করলে ২০২৩-এর ছবিটা অপেক্ষাকৃত ভালো। তবে একেবারে হিংসার ঘটনা ঘটবে না বা কেন্দ্রীয় বাহিনী এলেই হিংসা থেমে যাবে, নির্বাচন কমিশনার পাল্টে দিলেই নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হবে, এমনটাও ভাবার কোনও কারণ নেই।
এই প্রেক্ষিতে এটাই মনে হচ্ছে, সমস্যার গভীরে না গিয়ে রাজ্যপাল বড়ই ছেলেমানুষি করে ফেলছেন। বঙ্গের আম-জনতার নাড়ির স্পন্দন তিনি এখনও বোঝেননি। শুধু বাংলা শিখলেই তো আর বাংলার রাজনীতি আর বাংলার মানুষকে চেনা যাবে না। তা বুঝতে আরও বেশ কিছুটা সময় প্রয়োজন। অন্যদিকে আদালতের তরফ থেকেও কিছু কথা শোনা গেছে। আদালতেই বিচারপতি প্রশ্ন করছেন, ‘তাহলে নির্বাচন কি হচ্ছে? নির্বাচন কি করা যাবে?’ এদিকে আদালতই ঠিক করে দিচ্ছে ঠিক কত কেন্দ্রীয় বাহিনী আনতে হবে। এদিকে কেন্দ্রীয় সরকারও জানাচ্ছে যে এত সেনাবাহিনী একসঙ্গে দেওয়া সম্ভব নয়। আদালত এ নির্দেশও দিয়েছে, ৬১৩৬৬টা বুথে ৪টে করে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগাতে হবে । এখানেও প্রশ্ন, ৮ জুলাইয়ের মধ্যে সেটা আদৌ করা সম্ভব কি না তা নিয়েও। যদি না লাগানো হয়, তাহলে কি নির্বাচন হবে না? সব মিলিয়ে এখন যা ছবি, তাতে ২০২৩-এর পঞ্চায়েত নির্বাচন হওয়াটাই একগুচ্ছ প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে।
এদিকে বিরোধীদের পক্ষ থেকে কোনও প্রশ্ন উঠছে না, পঞ্চায়েতের রাস্তা, স্কুলে মিড-ডে মিল, কৃষক সমিতিতে কম দামে বীজ-সার মিলছে কি না, স্বাস্থ্যসাথীতে গ্রামের মানুষরা কোনও চিকিৎসা পাচ্ছেন কি না,গ্রামের মহিলারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পেয়েছেন কি না তা নিয়ে। পরিসংখ্যান বলছে, দেড় লক্ষ বিরোধী প্রার্থী। অথচ গ্রামের উন্নয়ন বা বিকাশ নিয়ে একটাও কথাও বলতে শোনা যাচ্ছে না কাউকে। বিরোধী নেতারা তো আমজনতার কাছেই নেই,হয় তাঁরা আদালতে, নয়তো রাজভবনে। মাঝে স্টপ-গ্যাপ হিসেবে রয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অফিস।
এই ঘটনায় আম-জনতা কিন্তু বেশ বুঝতে পারছেন, বিরোধী দলের এক বিরাট অংশ লড়াইটা আদালত আর রাজভবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান। এই প্রবণতা খুব বেশি দেখা যাচ্ছে স্যাফ্রন ব্রিগেডে। কারণ, তাঁদের সংগঠন নেই। চটকদারি দেখিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানো ছাড়া তাঁদের হাতে আর কোনও উপায় নেই। যে লোকটা স্পষ্ট কথা বলতে পারতেন সেই দিলীপ ঘোষকে টক্কর দিতে আদালত বা রাজভবনই শুভেন্দু সুকান্তের কাছে অনেক সহজ রাস্তা। এদিকে রাজভবনও তো হাত বাড়িয়েই রেখেছে। এরপর শুরু হবে কাঁদুনির পালা। ‘প্রচার করতে দিচ্ছে না’, ‘ভোট দিতে দিচ্ছে না’, এইরকম হাজারো অজুহাত। আর নির্বাচন হলে শেষ হাতিয়ার তো আছেই। ‘গণনাকেন্দ্রে কারচুপি’। সহজ সরল ফর্মুলা। কিন্তু এই সহজ ফর্মুলায় জং ধরেছে। বাংলার মানুষ সেটা বড্ড ভাল বোঝেন। জং ধরা অস্ত্রে কী তৃণমূলকে বধ করা সম্ভব, যেখানে সুপ্রিমো হিসেবে রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! এই কাঁদুনি আর গলার জোরে ভরসা করে ‘রামে’রা বসে থাকলে, তাদের জায়গা নিশ্চিত ভাবে এবার দখল করবেন ‘বামে’রা।