ভোটদান নয়, সবার নজরে রায়বেরিলি আর আমেথি

সব্যসাচী গুপ্ত

 

পঞ্চম দফায় ভোটদানের দিকে সকাল থেকে নজর ছিল বিজেপির। আর আমজনতার নজর ঘোরাফেরা করেছে আমেথি আর রায়বেরিলির দিকে। তবে প্রথম তিন দফার ভোটের হার ছিল কম। সেটা চিন্তায় রেখেছিল শাসক বিজেপিকে। ভোটের হার ঘোরাফেরা করেছে ৬৬ শতাংশের আশপাশে। গতবারের তুলনায় যা প্রায় ৪ শতাংশ কম। আর সেই কারণেই পঞ্চম দফায় ভোটের হার বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নারী ও যুবাদের এগিয়ে আসতে বার্তা দিতে দেখা যায় সোমবার সকালে।

এদিকে সবার নজর কেনই বা থাকবে না আমেথি আর রায়বেরিলির দিকে? কারণ, রায়বেরিলি আর আমেথি-ই এবার নিশ্চিতভাবে বুঝিয়ে দেবে আগামী দিনে উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে গান্ধি পরিবারের অবস্থান। আমেথি আর রায়বেরিলি জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে উত্তর প্রদেশের রাজনীতির ক্যানভাসে আগামী দিনে আঁকা হতে পারে এক নতুন ছবি। এদিকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধি যদিও সোমবার আগাম জয়ের বার্তা দিয়ে প্রত্যয়ের সঙ্গে জানালেন, সারা দেশেই পরিবর্তনের হাওয়া বইছে।

সোমবার উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৪টি, মহারাষ্ট্রের ৪৮টির মধ্যে ১৩টি, বিহারের ৪০টির মধ্যে ৫টি, ওড়িশায় ২১টির মধ্যে ৫টি, ঝাড়খণ্ডের ১৪টির মধ্যে ৩টিতে ভোটগ্রহণ হল। কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু ও কাশ্মীরের পাঁচটি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ১টি এবং লাদাখের একমাত্র আসনটিতেও সোমবার ভোটগ্রহণ হয়। এই দফায় ৮২ জন মহিলা-সহ মোট প্রার্থীর সংখ্যা ৬৯৫ জন।

উত্তরপ্রদেশে এ দফায় ভোট হল ১৪ আসনে। যার মধ্যে গতবার একটিমাত্র আসন জিতেছিল কংগ্রেস। রায়বেরিলি থেকে সোনিয়া গান্ধি। এবার সবার নজর সেদিকেই। কারণ, এটা যে রাহুল গান্ধির দ্বিতীয় নির্বাচনী আসন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভোটের প্রাথমিক হার মোটেই আহামরি নয়। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, সোমবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে গড়ে ৫৬. ৬৮ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছে লাদাখে। ৬৭. ১৫ শতাংশ। এখানে একটা কথা বলে রাখা শ্রেয়, নির্বাচন কমিশন ইদানীং ভোটের চূড়ান্ত হার ঘোষণা করছে চার–পাঁচ দিন পর। তা নিয়ে বিরোধী মহলে তৈরি হয়েছে প্রবল ক্ষোভ। সুপ্রিম কোর্টে এ নিয়ে মামলাও চলছে। শুনানি ২৪ মে।

বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের কাছে পঞ্চম দফাও ছিল যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের। কারণ, ছয় রাজ্য ও দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের এই ৪৯ আসনের মধ্যে গতবার বিজেপি জিতেছিল ৩২টি, জোটসঙ্গী ধরলে সংখ্যাটা পৌঁছায় ৪১–এ। কংগ্রেসসহ ‘ইন্ডিয়া’ জোটের সংগ্রহ মাত্র ছয়। তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে এনডিএকে গতবারের ট্রেন্ড ধরে রাখতেই হবে। আর সেখানেঅই উঠছে বড় প্রশ্ন।

প্রশ্নটা বারবার ঘুরে ফিরে আসছে প্রধানত মহারাষ্ট্র, বিহার ও উত্তর প্রদেশের জন্য। মহারাষ্ট্রের ভোট এই দফাতেই শেষ। এই পর্বের মোট ১৩ আসনের মধ্যে গতবার বিজেপি ও তার জোট শিবসেনা বিরোধীদের একটিও জিততে দেয়নি। প্রশ্ন এখানেই, এবারও কি তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে? শিবসেনা ও এনসিপির ভাঙন বিজেপিকে নিশ্চিন্তে রাখতে পারবে কি না তা নিয়েও জল্পনা চলছে বিস্তর। প্রশ্নগুলো উঠছে, কারণ, মহারাষ্ট্র থেকে বিজেপির পক্ষে আশাব্যঞ্জক খবর আসছে না। উদ্ধব ঠাকরে ও শারদ পাওয়ারের প্রতি সহানুভূতির হাওয়া থাকার খবর শেষ পর্যন্ত সত্য হলে বিজেপির পক্ষে চিন্তার। একই রকম চিন্তা বিহার নিয়েও। সেখানে ভোট হওয়া পাঁচ আসনে বিজেপি–জেডিইউ জোট গতবার বিরোধীদের দাঁত ফোটাতে দেয়নি। পাঁচটিই তারা জিতেছিল।এদিকে উত্তরপ্রদেশে এ দফায় ভোট হলো ১৪ আসনে। এসব আসনের মধ্যে গতবার একটিমাত্র আসন জিতেছিল কংগ্রেস। পাশের আসন আমেথিতে গতবার রাহুল হেরেছিলেন স্মৃতি ইরানির কাছে। এবার আমেথিতে কংগ্রেসের প্রার্থী হন গান্ধি পরিবারের চল্লিশ বছরের নির্বাচনী এজেন্ট কিশোরীরাল শর্মা। কিন্তু রায়বেরিলিতে রাহুলের সম্ভাব্য জয় নিয়ে যতটা চিন্তিত রাজনীতি সচেতন মানুষ, তার থেকেও তাঁদের বেশি নজর ছিল আমেথির ওপর। কারণ, এই দুই আসন জিততে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। স্মৃতি ইরানিকে হারাতে পারলে প্রিয়াঙ্কার সাংগঠনিক ক্ষমতা যেমন স্বীকৃতি পাবে, তেমনই চনমনে হয়ে উঠবে উত্তরপ্রদেশের রাজ্য রাজনীতিও। পাশাপাশি যে আইসিইউ-এ চলে গেছে কংগ্রেস, সেখান থেকেও বের হওয়ার সম্ভাবনা থাকছে।

সোমবার উত্তর প্রদেশে ভোট হলো রাজধানী লখনৌ ছাড়া বুন্দেলখন্ড অঞ্চলেও। লখনৌয়ে বিজেপির প্রার্থী ছিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। তাঁর জয় নিয়ে বিজেপি নিশ্চিত হলেও বুন্দেলখন্ডের আসনগুলো চিন্তায় রেখেছে। বিএসপি নেত্রী মায়াবতী এই ভোটে আশ্চর্যজনক নিষ্প্রভ হলেও যেটুকু প্রচার তিনি জোরের সঙ্গে করছেন তা এই বুন্দেলখন্ড এলাকায়। দলিত ও অনগ্রসর মানুষজন বরাবর তাঁকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর ভোট বিএসপি টেনে নিলে তার কী প্রভাব বিজেপির ভোটবাক্সে  পড়বে তা নিয়ে চিন্তিত স্যাফ্রন ব্রিগেড।

এদিন ভোট হয়েছে ঝাড়খণ্ডের ৩ ও ওড়িশার ৫ আসনেও। ঝাড়খণ্ডের তিনটি আসনই ছিল বিজেপির দখলে। এবার ওই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের বন্দিদশা কতটা সহানুভূতির হাওয়া বওয়াবে তার ওপর নির্ভর করছে বিজেপির ভাগ্য। অন্যদিকে ওড়িশার ৫ আসনের মধ্যে ৩টি ছিল বিজেপির দখলে। আসন বাড়াতে এবার এই রাজ্য বিজেপির পক্ষে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

এর পাশাপাশি লাদাখেও সোমবার ভোট গ্রহণ হয়। যেখানে বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চালাচ্ছে ক্ষুব্ধ বৌদ্ধ সম্প্রদায়। অনশন সত্যাগ্রহ করছেন পরিবেশ সচেতন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন শিক্ষাবিদ সোনম ওয়াংচুক। আবার এরই পাশাপাশি কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থনের প্রশ্নে মুসলমান অধ্যুষিত কারগিলের ন্যাশনাল কনফারেন্সের সব পদাধিকারী একযোগে পদত্যাগ করেছেন। তাঁরা দাঁড় করিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী। বিজেপি এই আসন হারালে গত দশ বছরের ধারাবাহিকতা যেমন নষ্ট হবে তেমনই নতুন করে আলোচিত হবে লাদাখের সীমান্ত পরিস্থিতি।

এদিকে বিজেপির ‘চার শ পার’-এর দাবি পূরণ করতে হলে কিংবা নিদেনপক্ষে একার ক্ষমতায় ২৭২ পেতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে গতবারের ফল ধরে রাখতে হবে। তা পারবে কি না, এবার সেদিকেও নজর রয়েছে সবার। কারণ, ২৭২-এ পৌঁছাতে যে কয়টি রাজ্যে বিজেপি তার আসন বাড়াতে চাইছে সে তালিকায় রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, তেলেঙ্গানা ও অন্ধ্র প্রদেশ। যে সাত আসনে পশ্চিমবঙ্গে সোমবার ভোট হলো, সেগুলোর মধ্যে তিনটি আছে তাদের দখলে। তবে এটাই দেখার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) চালু করা ও সেই আইনে নাগরিকত্ব দানের মধ্যে দিয়ে আদৌ কতটা মন জয় করতে পারল মতুয়ার।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

fifteen + fifteen =