পারিবারিক দিক থেকে এখনও বলিউডে সবচেয়ে শক্তিশালী কাপুর পরিবার। আর এই পরিবারের মধ্যমণি ছিলেন রাজ কাপুর, ঠিক যেমন রামায়ণের ইক্ষাকু বংশের শ্রীরামচন্দ্র। অবিভক্ত ভারতের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের পেশোয়ার শহরে রাজ কাপুরের জন্ম ১৯২৪ সালে। ছয় সন্তানের মধ্যে প্রথম রাজ। অনুজ হিসেবে পেয়েছিলেন শশী ও শামি কাপুরকে। বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুর জীবিকার খোঁজে বোম্বেতে চলে আসেন। সেই সঙ্গে ভারতীয় গণনাট্যের প্রথম সারির নেতা পৃথ্বীরাজ শুধু সপরিবারে ভারতের নানা শহরে আস্তানা গেড়েছিলেন তাই নয়, পুত্রের রক্তের মধ্যেও সঞ্চারিত করেন তাঁর খোলা চোখে গরিব ও নিচু তলার মানুষকে দেখার শক্তিকে। এই সুবাদে বেশ কিছুদিন কলকাতাতেও থাকতে হয়েছিল ছোট্ট রাজকেও। ফলে খুব স্বাভাবিক ছন্দেই এই শহরের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তাঁর স্মৃতি। এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়, তাঁর প্রথম ছবির সাথেও জড়িয়ে রয়েছে এই কলকাতা। ১৯৩৫-এ তৈরি ‘ইনকিলাব’ ছবিতে তাঁর আবির্ভাব শিশু-শিল্পী হিসেবে, যার পরিচালনা দেবকী বসুর আর প্রযোজনা নিউ থিয়েটার্সের।
রুপোলি পর্দার জগতে শুরুয়াৎ কম বয়েসে হলেও ডানা মেলতে আরও সময় নিয়েছেন রাজ কাপুর। ইনকিলাব মুক্তির বারো বছর পর ১৯৪৭-এ ‘নীল কমল’ ছবিতে মধুবালাকে নায়িকা হিসেবে পাশে নিয়ে আত্মপ্রকাশ তাঁর। এরপর ১৯৪৯ সালে ‘বারসাত’ সিনেমায় অভিনয় তাঁকে এনে দেয় তারকা খ্যাতি। এরপর ১৯৪৯-এ তৈরি ‘আন্দাজ’ পৌঁছায় এক মেলোড্রামার স্তরে। এর আগে ১৯৪৮ সালে ‘আগ’ সিনেমার মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন রাজ। আর বহির্বিশ্বে তাঁকে চিনল ১৯৫১-তে মুক্তি পাওয়া ‘আওয়ারা’র হাত ধরে। ভারতবর্ষ থেকে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নে অসম্ভব জনপ্রিয় হয় এই সিনেমার ‘আওয়ারা হুঁ’ গানটি। ‘আওয়ারা’ পরবর্তী ছবি ‘বুটপালিশ’ থেকে শুরু করে শ্রী-৪২০ এর মতো সিনেমায় রাজ কাপুর তুলে ধরেছেন একটি দেশের গ্রাম থেকে শহরের রূপান্তরের পর্যায়ে যে উত্থান-পতন, যে রাজনৈতিক সংঘর্ষ। আর তা যেন ফুটে উঠেছে এক ধরনের রূপকথার আঙ্গিকে তিনি তুলে ধরেছেন শহুরে লোকনাট্যে। ‘বুটপলিশ’-এ পটভূমি একটি নারী ও শিশুর সাথে আদালত এবং আইনের সংঘর্ষ বা ‘শ্রী-৪২০’-র মতো বেশ কয়েকটি ছবিতে রাজ কাপুর সমাজের কথা বললেও সেখানে প্রেম আর গান যেভাবে পরতে পরতে জড়িয়ে গেছে, তাতে এগুলি উন্নীত হয়েছে ব্যালাডের স্তরে। যেমন ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’ গানটি এক অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায় রাশিয়ায়। অন্য়দিকে ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়’-এ গাঁথা হয়েছে উত্তর ভারতের এক সম্পন্ন চাষির চোখ দিয়ে ভারতীয় নব জীবনগাথা। এটা মানতেই হবে, ‘শ্রী ৪২০’ (১৯৫৫), এবং ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪) মতো গুরুত্বপূর্ণ সিনেমায় অভিনয় এবং পরিচালক হিসেবে তার প্রতিভা ছিল প্রশ্নাতীত। শুদু তাই নয়, ‘শ্রী ৪২০’ (১৯৫৫) সিনেমাটি ছিল ওই বছরের সর্বাধিক উপার্জনকারী চলচ্চিত্র। এই সিনেমার আইকনিক গান ‘মেরা জুতা হ্যায় জাপানি’-সদ্য স্বাধীন ভারতে ভীষণ জনপ্রিয় হয়। এরই পাশাপাশি সংগীত, গল্প বলা এবং রাজ কাপুরের অভিনয় সিনেমাটিকে একটি কালজয়ী ক্লাসিকে পরিণত করে। এরপর ‘সঙ্গম’ (১৯৬৪), রাজ কাপুরের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র, যার শুটিং হয়েছিল বিদেশে। লন্ডন, প্যারিস ও সুইজারল্যান্ডের মতো আইকনিক লোকেশনগুলোতে এর দৃশ্যায়ন করা হয়। সেই সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল চলচ্চিত্রগুলির তালিকায় ‘সঙ্গম’-এর নামও রয়েছে। তাঁর এই সৃষ্টির মধ্য দিয়ে পঞ্চাশ দশকে আরব সাগর উপকূলে আদতে নবজাত জাতিরাষ্ট্রের একটি জীবনীও রচনা করে চলেছিলেন তিনি। অথচ কী অলৌকিক সমাপতন, এই ১৯৫৫-তেই কলকাতায় যখন সত্যজিৎ রায় পথের ‘পাঁচালি নির্মাণ’ করছেন, তখনই তদানীন্তন বোম্বাই শহরে রাজ কাপুর ‘শ্রী- ৪২০’ -তে আঁকছেন সমাজের নিচের মহলের অন্য জীবন কথা। একদিকে যখন সাহিত্য-সমর্থিত বাস্তববাদ চলচ্চিত্রের জন্য একটি মানচিত্র তৈরি করতে ব্যস্ত, ঠিক তারই উল্টোদিকে রাজ কাপুর মেলোড্রামার আদলে গ্রাম থেকে শহরে আসার অভিজ্ঞতা ও রাষ্ট্রীয় বিধিসমূহ পরীক্ষা করে চলেছেন সেলুলয়েডে। যে কারণে আওয়ারা (১৯৫১), বুটপালিশ (১৯৫৪), শ্রী ৪২০ (১৯৫৫), জিস দেশ মে গঙ্গা বহেতি হ্যায় (১৯৫৯) নিঃসন্দেহে উত্তর স্বাধীনতা পর্বে ভারতীয় জনজীবনে আধুনিকতার একটি দলিল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। এর পাশাপাশি অবশ্যই বলতে হবে ১৯৫৯-এ মুক্তি পাওয়া ‘আনাড়ি’-র কথা। হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় পরিচালিত রাজ কাপুর-নূতন, মতিলাল ও ললিতা পাওয়ার অভিনীত এই ছবি শুধু হিন্দিতে নয়, পরবর্তী সময়ে ছবির গল্প স্থান পায় তামিল ও তুর্কিশ ভাষাতেও। সঙ্গে কোনও ভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না ১৯৭০-এ মুক্তি পাওয়া ‘মেরা নাম জোকার’-এর কথাও। এই ছবি পরিচালনা করতে গিয়ে নিজের সম্পত্তি পর্যন্ত বন্ধক রাখেন রাজ কাপুর। এই ছবির প্রোডাকশনের কাজও চলে প্রায় ছয় বছর। এই ছবিতে নাকি ফুটে উঠেছে রাজ কাপুরের জীবনের বেশ কিছু অংশ। আর এই ছবির ঝুলিতে আসে তিনটি জাতীয় পুরস্কারও। ঋষি কাপুর ১৮তম বেস্ট চাইল্ড আর্টিস্ট হিসাবে জাতীয় পুরস্কার পান৷ ‘এ ভাই যরা দেখকে চলো’ গানের জন্য মান্না দে বেস্ট মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসাবে পান জাতীয় পুরস্কার ও রাধু কর্মকার পান বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফির জাতীয় পুরস্কার। পাশাপাশি, সেরা ছবি, সেরা মিউজিক ডিরেক্টর, সেরা সাউন্ড ডিজাইন, সেরা সিনেমাটোগ্রাফি, সেরা মেল প্লেব্যাক সিঙ্গার বিভাগে আসে পাঁচটি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডস। এই প্রসঙ্গেই ২০১৫ সালে বিবিসি রেডিও ৪-এর সিরিজ ‘ইনকারনেশন: ইন্ডিয়া ইন ৫০ লাইভস’-এ ইতিহাসবিদ সুনীল খিলনানি বলেন, ‘রাজ কাপুর ভারতীয় সমাজবাদের মধ্যে রোমান্স, যৌনতা, গান এবং প্রাণ এনেছিলেন।’ এদিকে এতো কিছুর মাঝে ১৯৪৮ সালে রাজ কাপুর প্রতিষ্ঠা করেন ঐতিহাসিক আরকে ফিল্ম স্টুডিও। বহু ব্লকবাস্টার সিনেমা এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতির সঙ্গে যার নাম জড়িয়ে পরতে পরতে।
রাজ কাপুরের কোনও প্রভাব বাংলা সিনেমাতে ছিল কি না তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। অমিত মৈত্র এবং শম্ভু মিত্র পরিচালিত এবং খোয়াজা আহমেদ আব্বাস এর রচিত, ‘জাগতে রহো’ ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ কাপুর। সিনেমাটিতে রাজ কাপুর অবিনয় করেন এক দরিদ্র গ্রাম থেকে সুস্থ জীবন-যাপনের জন্য শহরে চলে আসা সহজ সরল এক মানুষের চরিত্রে। ছবিটির শেষ দৃশ্যে নার্গিসকে ক্যামিও চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। এই সিনেমা বাংলাতেও মুক্তি পায় ‘একদিন রাতে’ নামে। অগ্রজর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অভিনেতা-পরিচালক বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে সবসময় বাংলায় কথা বলতেন রাজ সাহেব। উনি কলকাতায় বড় হন। শাম্মি কাপুর, শশী কাপুরও একটা সময়ে কলকাতায় থাকতেন। পৃথ্বীরাজ চৌহান একটা সময়ে কলকাতার একটি স্টুডিওতে চাকরিও করেছেন। তাই বাংলার একটা প্রভাব ওঁর উপর ছিল।’ সঙ্গে এও জানান,’কলকাতায় বিখ্যাত ডিরেক্টর সুশীল মজুমদারের থার্ড অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবেও কাজ করেছেন রাজ সাহেব। ফলে, বাংলার প্রভাব ওঁর উপর ছিলই। তবে, বাংলা সিনেমার উপর ওঁর প্রভাব সেভাবে পড়েনি। উনি যে ধরনের সিনেমা বানাতেন তা ভীষণ মিউজিক্যাল ছিল। অফবিট ছবি বানাতেন রাজ সাহেব। ভালো ভালো জায়গায় শুটিং করতেন। বিদেশের ব্যাপারেও বিরাট আউটলুক ছিল, যেটা বাংলার সঙ্গে ঠিক ম্যাচ হত না। একইসঙ্গে গ্ল্যামারাস ফিল্ম বানাতেন রাজ সাহেব। যার জন্য ওনাকে ‘গ্রেটার শো ম্যান’ বলা হয়। সেটাও বাংলার সঙ্গে খাপ খেত না। তবে বাঙালিকে উনি শ্রদ্ধা করতেন। যার জন্য উনি বাংলা ছবিও করেছেন। আর হিন্দি সিনেমার জগতে ওঁনাকে সবাই ম্যাটিনি আইডল হিসেবে দেখত। রাশিয়াতে জনপ্রিয় ছিলেন খুব।’ এই প্রসঙ্গে অভিনেতা অনিন্দ্য পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানান, ‘আমার মনে হয় না বাংলা সিনেমার রাজ কাপুরের প্রভাব আছে সেভাবে। বাংলা সিনেমা অনেক বেশি সাহিত্য নির্ভর। তবে, হ্যাঁ ভারতীয় সিনেমায় তিনি আধুনিকতা এনেছিলেন। আরবান মিডল ক্লাসের দুঃখ কষ্ট ধরার চেষ্টা করেছিলেন রাজ কাপুর। তবে সেটাও পজিটিভ দিক থেকে।’
রাজ কাপুরকে যে আমরা বড় ‘শো-ম্যান’ বলি কারণ তিনি ছবির সঙ্গে সঙ্গে বিনোদনেও আনেন নতুন এক মাত্রা। ‘আওয়ারা’ থেকে ‘ববি’ এমনকি ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ পর্যন্ত রাজ কাপুর এমন একটি ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের রূপক যে ভাবে সার্থকভাবে উপহার দিয়েছেন, তাতে আমরা কখনওই বুঝতে পারিনি যে এক নয়া বাণিজ্যের পত্তন তিনি করছেন। যেখানে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর যুগ্ম উপস্থিতি থাকলেও লক্ষ্মীর দিকেই পাল্লা ভারী হয়ে চলেছে। ‘ববি’, ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ বা ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ জাতীয় ছবিতে সব সময়েই নারী শরীরকে ব্যবহার করছেন তিনি। খানিকটা রজার ভাদিম যেভাবে ব্রিজিত বার্দোকে ফরাসি নব তরঙ্গের সময় ব্যবহার করেছেন, ঠিক যেন সেভাবেই ডিম্পল কপাডিয়া বা জিনাত আমনকে প্রদর্শনযোগ্য নারীত্বের মডেল হিসেবে ব্য়বহার করছিলেন রাজ। আসলে রাজ কাপুর ভারতীয় গণনাট্যের আদর্শ নিয়ে শুরু করলেও, নববাস্তববাদের অনেক প্রভাব তার মধ্যে পড়েও ছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হয়ে দাঁড়ান স্বপ্নের জাদুকর।
তবে রাজ কাপুর মানুষ হিসেবে আপাতভাবে ছিলেন এক ‘কমন ম্যান’। প্রথম বিদেশ সফরে রাশিয়ায় যাওয়ার সময় একবার জেনেভায় স্টপ-ওভার পান। সেই সুযোগে তিনি চার্লি চ্যাপলিনের কাছে চলে যান। যে চার্লিকে তিনি সারা জীবন ভজনা করেছেন, তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর এই সুযোগ তিনি ছাড়তে পারেননি। ‘শ্রী-৪২০’ যখন আপামর দুনিয়ায় বক্স-অফিস হিট, তখন একটি ভারতীয় ফিল্মের ডেলিগেশানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রাজ কাপুর। তখন ইরানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে। সেখানে রাজ কাপুর কী সারল্যে বলেন, ‘আমি কখনওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে হাজির থাকিনি তো! আমাকে যখন কালো পোশাক পরতে হল তখন অধ্যাপকদের মতন কত বড় হয়ে গেছি!’ রুপোলি পর্দায় রাজ কাপুর আর নার্গিসের জুটি তুলেছিল এক আলোড়ন। অস্বীকার করার কোনও উপায়-ই নেই, হিন্দি সিনেমার অন্যতম সেরা রোমান্টিক জুটি। এই জুটি যে শুধু রুপোলি পর্দার গণ্ডিতেই আবদ্ধ ছিল তা নয়। এর প্রভাব পড়ে রাজ কাপুরের ব্যক্তিগত জীবনেও। রাজ-নার্গিসের জুটির সূচনা ১৯৪৮-এ রাজ কাপুর পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘আগ’ থেকে। তাঁদের রসায়ন মন কেড়েছিল দর্শকদের। তাঁদের পর্দায় দেখে মনে হতো, জন্মই হয়েছে পরস্পরের জন্য। তবে এই প্রেম থেকে যায় যেন ছায়া হয়েই। বাস্তবে অনেকটা পথ একসঙ্গে হাঁটলেও, একটা সময় দুজনের জীবনে আসে বাঁক। রাজ কাপুরের জীবনে এটাও সত্য যে, বার বার সম্পর্কে জড়িয়েছেন তিনি। বিভিন্ন নায়িকাদের সঙ্গে সম্পর্কও ছিল তাঁর। তবে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন নার্গিসকে। এদিকে রাজ কাপুরের হাইট নার্গিসের চেয়ে খুব বেশি ছিল না বলে নার্গিস কখনও হিল পরতেন না। আর পর পর কয়েক দিন শুটিংয়ে নার্গিসের এই হিল জুতো পড়া দেখে রাজ বুঝতে পারেন নতুন কোনও পুরুষ এসেছে নার্গিসের জীবনে। হ্য়াঁ,নার্গিসে জীবনে হঠাৎ-ই আসেন সুনীল দত্ত। আসলে নার্গিসও বারবার সম্পর্কের মর্যাদা চেয়ে হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। তিনি চাইতেন সম্পর্কের একটা পরিচয় হোক। এসবের মাঝে হঠাৎ-ই ‘মাদার ইন্ডিয়া’র সেটে লাগে আগুন। যেখান থেকে নার্গিসকে নিজের জীবন বাজি রেখে বাঁচান সুনীল দত্ত। এরপরই সুনীল দত্তের প্রবেশ নার্গিসের জীবনে। নার্গিসও যা চাইছিলেন সেই পরিচয় তাঁকে দেন সুনীল দত্ত। যে ‘আগ’ থেকে শুরু রুপোলি পর্দার সেরা রোম্যান্টিক জুটির পথচলা, বাস্তবে সেটে লেগে যাওয়া সেই আগ-ই বড় ধাক্কা দেয় বলিউডের শো-ম্যানকে। এরপর থেকে মদে ডুবে যান তিনি।
নিজের বইতে রাজ কাপুর এবং নার্গিসের সম্পর্ক নিয়েও মুখ খুলেছেন রাজপুত্র ঋষি। এও লিখেছেন এক মহিলায় সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন না রাজ। অভিনেত্রী বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গেও বাবা রাজ কাপুরের ঘনিষ্ঠতার কথা জানিয়েছেন ঋষি। তবে বৈজয়ন্তীমালা অবশ্য এ সম্পর্ককে কখওনই স্বীকার করেননি। বৈজয়ন্তীমালার এই মনোভাব না-পসন্দ ঋষির। তবে ঋষি এও জানিয়েছেন, অভিনেত্রী বৈজয়ন্তীমালার সঙ্গে রাজ কাপুরের যখন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তখন তাঁর মা কৃষ্ণা ছোট্ট ঋষি কাপুরকে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন। মেরিন ড্রাইভের নটরাজ হোটেলে ওঠেন তাঁরা। এরপর বাড়ি ফেরেন রাজের সঙ্গে বৈজয়ন্তীমালার সম্পর্ক ভাঙার পরই। সঙ্গে এও জানিয়েছেন, মহিলাদের পাশাপাশি মদেও তীব্র আসক্তি ছিল রাজ কাপুরের। দেশ-বিদেশের অত্যন্ত দামী সব মদ ফছন্দ ছিল তাঁর। তাঁর মৃত্যুর পর আলমারিতে মেলে না খোলা অসংখ্য সুরার বোতল। এতকিছুর পরেও নিজের বাবার প্রতি শ্রদ্ধা রেখেছেন ঋষি। জানিয়েছেন প্রথম জীবনে বাবকে ভয় পেলেও পরবর্তী সময়ে তাঁর নিজের বাবার প্রতি শ্রদ্ধা বেড়েছে। বাবার মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন নিজের গুরুকে। তাঁর সঙ্গে তিনটি ছবিতে কাজ করার সুযোগ পাওয়ায় নিজেকে ধন্য মনে করেন ঋষি।
রাজ কাপুরের সিনেমায় হয়তো অনেকেই লক্ষ্য করেছেন, সাদা শাড়িতে দেখা গেছে নায়িকাদের। কখনও নার্গিস, কখনও ‘সঙ্গম’-এ বৈজয়ন্তীমালা আবার কখনও বা ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’-এ জিনাত আমন। এর পিছনেও রয়েছে নাকি এক ঘটনা। রাজ কাপুরের স্ত্রী কৃষ্ণা রাজ কাপুর সবসময়েই থাকতেন সাদা পোশাকে। আর সেই কারণেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অনেকে তাঁকে ‘লেডি ইন হোয়াইট’ বলেও ডাকতেন। কৃষ্ণাজি আর রাজ কাপুরের প্রেম কাপুর পরিবারে প্রবাদসম। এই প্রেম কাহিনীর সূত্রপাত, অভিনেতা প্রেমনাথের বাড়িতে। সেখানে বছর ১৬-র কৃষ্ণাকে একমনে তানপুরা বাজাতে দেখেন বছর ২২-র রাজ। কৃষ্ণার পরনে তখন সাদা শাড়ি। ‘লাভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট’ বলতে যা বোঝায় হলোও ঠিক তাই, এক দেখাতেই কৃষ্ণার প্রেমে পড়ে যান রাজ কাপুর। সেই সাদা শাড়িতে দেখা প্রথম দর্শনের মুগ্ধতার জন্যই বারবার করে রাজ কাপুরের নায়িকাদের দেখা গিয়েছে সাদা শাড়িতে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, কৃষ্ণাজির জন্ম রেওয়া-তে। তাঁর বাবা রায়সাহেব কর্তরনাথ মলহোত্র ছিলেন রাজ কাপুরের বাবা পৃথ্বীরাজ কাপুরের মায়ের দিকের তুতো ভাই। ওঁদের বিয়েটা লাভ ম্যারেজ, আবার অ্যারেঞ্জডও। কৃষ্ণাজির পাঁচ সন্তান। রণধীর, ঋষি, রাজীব, রিমা আর রিতু।
এই রাজ কাপুরের ডাকে সাড়াই দেননি বাংলা সিনেমার হার্টথ্রব সুচিত্রা সেন। সুচিত্রা সেন ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত দাপিয়ে কাজ করেছেন সিনেমায়। ডাক পড়েছিল বলিউড থেকেও। অভিনয় করেছিলেন ‘আঁধি’-তে। তবে রাজ কাপুরের ছবিতে ডাক পেয়েও অভিনয় করেননি তিনি। অমিতাভ চৌধুরী নিজের লেখা ‘আমার বন্ধু সুচিত্রা সেন’-এ এই প্রসঙ্গে জানান সুচিত্রার রাজ কাপুরকে ফেরানোর সেই ঘটনার কথা। এক দাপুটে চরিত্রের অফার নিয়ে সুচিত্রা সেনের বাড়ি পৌঁছে গিয়েছিলেন রাজ। জানিয়েছিলেন সুচিত্রা সেন সেই ছবিতে কেন্দ্রিয় চরিত্রে অভিনয় করছেন। সবটা শুনবে বলে চেয়ারে বসতে যাচ্ছিলেন সুচিত্রা, এমন সময় সুচিত্রা সেনের পায়ের কাছে বসে পড়েন রাজ, হাতে ফুলের বোকে। বিষয়টা মোটেও ভাল চোখে দেখেননি সুচিত্রা। পত্রপাঠ জানিয়ে দেন তিনি এই ছবি করবেন না। যে রাজ কাপুরের সঙ্গে কাজ করার জন্য বলিউডের বাঘা বাঘা অভিনেত্রীরা মুখিয়ে থাকতেন, তাঁকে পলকে ফেরাতে দু’বার ভাবেননি সুচিত্রা সেন। এরপর থেকে কোনও দিন-ই তিনি রাজ কাপুরের সঙ্গে কাজ করেননি। কারণ হিসেবে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, রাজ কাপুরের ব্যবহার তাঁর খুব একটা ভাল লাগেনি। সুচিত্রা সেন বলেই এটা বোধহয় সম্ভব ছিল।
তবে রাজ বিশ্বাস করতেন যে ভালোবাসা সম্পর্কের বিশুদ্ধতার উপরে নির্ভর করে, শারীরিক সৌন্দর্যের উপরে নয়। এই উপলব্ধি থেকেই এক গল্প নিয়ে বানাতে চেয়েছিলেন সিনেমাও। যার ফসল ‘সত্য, শিবম সুন্দরম’। আর এই সিনেমাকে কেন্দ্র করেই রাজ কাপুরের সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের। শোনা যায়, এই সত্যম, শিবম, সু্ন্দরমে অভিনয় করতে রাজি হয়েছিলেন লতা। তবে পরে এক বিশেষ কারণে প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন লতা। এই প্রসঙ্গে সাংবাদিক বীর সাংভির আত্মজীবনীতে রাজ কাপুর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে জানিয়েছেন অনেকেরই অজানা এই কাহিনি। সাংভি এই প্রসঙ্গে লেখেন, রাজ বলেছিলেন, ‘একটা পাথর হাতে নিন। তাতে কিছু ধর্মীয় চিহ্ন রাখুন এবং তাতেই তা ঈশ্বরে পরিণত হবে। আপনি কী ভাবে কোন বিষয় দেখেন, এই দৃষ্টিভঙ্গীটাই গুরুত্বপূর্ণ। ধরুন, আপনি একটা সুন্দর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। কিন্তু পরে আবিষ্কার করলেন যে এটি একটি কুৎসিত মেয়ের কন্ঠ’। আর এই ‘ কুৎসিত’ ব্যাপারটার প্রসঙ্গ আসতেই রেগে যান লতা। এরপরই এই সিনেমায় আর গান গাইবেন না বলে মনস্থির করেছিলেন বলিউডের সুরসম্রাজ্ঞী।এটাই যে প্রথম ঘটনা ছিল তাও নয়। বীর সাংভি তাঁর সেই আত্মজীবনীতে এও জানান, এর আগেও এই ছবির স্বার্থে রাজ জানিয়েছিলেন লতার রূপ এবং গলার স্বরের মধ্যে যে এই বৈপরীত্য, সেই বিষয়টাই ভীষণভাবে টেনেছিল তাঁকে। তবে এই ঘটনায় রাজের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে থাকে লতার সঙ্গে। অথচ, লতা একসময় রাজের কাছে ছিলেন ছোট বোনের মতোই। পরে অবশ্য তাঁর সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি মিটমাট করে নেন রাজ!
কয়েক দশকের ফিল্মি ক্যারিয়ারে অসংখ্য ক্লাসিক ছবি থেকে সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন রাজ কাপুর। ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে রাজ কাপুর একটা প্রতিষ্ঠানে নাম, আবেগের নাম, সিনেপ্রেমীদের কাছে ভালোবাসার নাম,পূর্বসূরির সেই লিগ্যাসি আজও স্বমহিমায় বহন করে চলেছে কাপুরদের বর্তমান প্রজন্ম। রাজ কাপুরের কাজ এখনও ভারতীয় সিনেমাকে ঋদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে। সেই কারণেই ১৯৮৮ সালে তার মৃত্যুর প্রায় চার দশক পরও আজও তিনি ভারতের সবচেয়ে প্রিয় তারকাদের একজন।