সামনে এল শেখ হাসিনার ‘আয়নাঘর’ সম্পর্কিত বেশ কিছু তথ্য!

‘আয়নাঘর’। এই শব্দবন্ধটা পরিচিত ছিল শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে। নামের মধ্যেই কোথাও একটা লুকিয়ে রয়েছে ভীষণ রকম ধোঁয়াশা।আয়না ঘর আদতে আলো বাতাসহীন একটি কক্ষ। সেখানে সারাক্ষণ ঘড়ঘড়িয়ে চল ফ্যান। বাংলাদেশের মাটিতে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, শেখ হাসিনার আমলে তৈরি এই আয়নাঘরেই রাখা হতো গুম করে রাখা মানুষজনকে। আয়নাঘর আসলে গোপন বন্দিশালা বা ডিটেনশন ক্যাম্প। এর দায়িত্বে রয়েছে প্রতিরক্ষা দফতর ডিজিএফআই। শেখ হাসিনা বিদায় নেওয়ার পর কথা উঠেছে আয়নাঘরের বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।

কাদের রাখা হতো ওই আয়না ঘরে তা নিয়েও রয়েছে বিস্তর জল্পনা। কারণ, শোনা যায় এও হাসিনার আমলে বিরোধীদলের বহু নেতা কর্মী নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন।তাঁরা কোথায় তাদের কোনও হদিস নেই। এমনকি সেনাবাহিনীর লোকজন রয়েছেন ওই তালিকায়। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থার খবর অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ৬০৫ জন গুম হয়েছেন। এদের অনেকেই বিএনপি সমর্থক। এদের অনেককেই জঙ্গি বলে আটক করা হয়। এদের অনেকে ফিরলেও তারা প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। তবে এদের মধ্যে দুজন এই আয়নাঘর নিয়ে কিছু তথ্য সামনে আনেন। এই তালিকায় রয়েছেন সেলিম নামে একজন। তাঁকে নাকি আচমকাই মাথায় টুপি পরিয়ে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে তাঁকে জানানো হয় তাঁর ঠাঁই হবে আয়না ঘরে।

সূত্রে খবর, সেলিম এই আয়না ঘর সম্পর্কে জানিয়েছেন, সকালের খাবারে বিস্কুট দেওয়া হতো। দিনরাত একটি একজস্ট ফ্যান চলত শব্দ করে। মাঝেমধ্যে বিমান ওঠানামার শব্দ পেতেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে বিনা কারণে মানুষজনকে গুম করার অভিযোগ উঠতো সামরিক গোয়েন্দাদের  বিরুদ্ধে। মূলত আওয়ামী লিগ বিরোধীদের তুলে এনেই বিভিন্ন অভিযোগে আটকে রাখা হতো। সেলিম কোনও হাইভ্যালু বন্দি ছিলেন না। তাই তিনি মুক্তি পান।

ওই আয়নাঘরে এর একজন বন্দি ছিলেন হাসিনুর রহমান। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সেনার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল। সেলিমের আগে ওই কক্ষে যাঁরা বন্দি ছিলেন, তারাও তার অপহরণকারীদের পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্ট সূত্র রেখে গেছেন। অনেকেই খাবারের সাথে দেওয়া মাংসের হাড় বা কোন শক্ত বস্তু দিয়ে ডিজিএফআইয়ের নাম কক্ষের দেয়ালে খোদাই করে লিখে গেছেন।

মালয়েশিয়া থেকে এক সাক্ষাৎকারে সেলিম এক সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ওই রুমের ভিতরে আপনার অনেক লেখা। ওয়ালের মধ্যে খোদাই করে লেখা। আমার মনে হচ্ছে এখানে কত লোককে যে রাখা হইছে এটা অনুভব করার মতো না। একেক জনের লেখার হাতের স্টাইল একেক রকম। ‘আমাকে ডিজিএফআই ধরে নিয়ে আসছে’, ‘আমাকে ডিজিএফআই অ্যারেস্ট করছিল বাড়ি থেকে’, এইরকম অনেক লেখা। অনেকে আবার নাম্বার লিখে রাখছে যে যদি সম্ভব হয় আমার পরিবারকে কেউ বইলেন যে আমাকে যেন খোঁজ করে, আমাকে সরকার এইখানে এইভাবে বন্দি করে রাখছে।’

হাসিনুর রহমানের অভিজ্ঞতা সেলিমের উল্টো। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রাক্তন এই লেফটেন্যান্ট কর্নেল শুরু থেকেই নিজের ‘হাই ভ্যালু’ বন্দি হওয়ার বিষয়টি বুঝতেন। তাকে আটক করা হয় ২০১৮ সালের ৮ অগাস্ট। তবে সেটি ছিল তার দ্বিতীয়বার গুম হওয়ার ঘটনা। তিনি প্রথমবার গুমের শিকার হয়েছিলেন ২০১১ সালের জুলাইয়ে। সামরিক বাহিনীতে তিনি পদকপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন; বীরত্বের জন্য পেয়েছিলেন ‘বীর প্রতীক’ খেতাব। র‍্যাবের একটি ইউনিটের অধিনায়ক থাকাকালে তিনি বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ২০১২ সালে ২৮ বছর চাকরি শেষে তাকে বরখাস্ত করা হয়। অভিযোগ হল, তিনি নিজেই জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন! এই অভিযোগ তিনি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন। মিরপুর ডিওএইচএস-এ নিজের বাসা থেকে তাঁকে যারা ২০১৮ সালে ধরে নিয়ে যায়, তাদের পরনে ছিল পুলিশের গোয়েন্দা শাখা বা ডিবির পোশাক। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা শ্রেয়, কাউকে আটক করার কোনো আইনি একতিয়ার ডিজিএফআই-এর নেই; ফলে, কাউকে অপহরণ করতে হলে এই সংস্থার সদস্যরা বেসামরিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় ধারণ করে।

২০১৮ সালের অগাস্টে তাকে তুলে নেয়ার পর হাসিনুর প্রায় ১৮ মাস নিখোঁজ ছিলেন। এরপর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাংকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তখন অন্য অনেক গুমের শিকার ব্যক্তিদেরদের মতো তিনিও নিজের গুম হওয়া নিয়ে বেশি তথ্য দিতে সম্মত হননি। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ইস্যুতে সরব হয়েছেন। নেত্র নিউজের একজন সম্পাদক এই ইস্যুতে তার সাক্ষাৎকারের প্রস্তাব রাখলে তিনি সম্মত হন।

সেলিম তার গুমের বিষয়ে কিছুই না জানলেও, হাসিনুর ছিলেন সামরিক বাহিনীর ভেতরকার একজন লোক। তিনি এই গোপন বন্দিশালার অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ও নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে বলতে পেরেছেন। তিনি জানান, ‘উত্তরে ১৪ তলা বিল্ডিং, দক্ষিণে মেস বি, তার মাঝখানে হল একটা মাঠ, মাঠের মাঝখানের ঠিক পূর্ব পাশে হল লগ এরিয়া হেড কোয়ার্টার, স্টেশন হেড কোয়ার্টার, এবং ইএনসির (প্রধান প্রকৌশলী) অফিস, পশ্চিম পাশে হল এমটি শেড, ডিজিএফআইয়ের এমটি শেড, এবং উত্তর-পূর্ব কোনে হল ডিজিএফআইয়ের মসজিদ। এই গুম হাউজটার ছদ্মনাম হলো আয়নাঘর।’

হাসিনুর রহমানের দেয়া এসব তথ্যের ভিত্তিতেই কারাগারটির অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয় বাংলাদেশের এখ সংবাদ সংস্থা। গুগল আর্থের স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত সাম্প্রতিক ছবি অনুযায়ী ওই ভবনটির ছাদ তারপুলিন বা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। হাসিনুর নিজেও সম্প্রতি পাশের একটি ভবনে গিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে ভবনটি আসলেই ছাউনি দিয়ে আবৃত।

এই আয়নাঘর সম্পর্কে সেলিম জানান, ‘ফ্যান বন্ধ করলে অনেক লোকের কান্নার শব্দ আসে, কিন্তু ওইটা ফ্যান ছাড়া অবস্থায় বোঝা যায় না।’ এর পাশাপাশি হাসিনুর রহমান জানিয়েছেন, ‘কোন কিছু যাতে শোনা না যায় এবং ভিতরের কোন শব্দ যাতে বাইরে না যায়, বড় এগজস্ট ফ্যান ইউজ করে, খুব বড় বড়। যেমন ওই প্রতি পাঁচটা রুমের সাথেই দুইটা এগজস্ট ফ্যান, অর্থাৎ, ওই দশটা রুমের সাথে চারটে এগজস্ট ফ্যান, যাতে কোন শব্দ ভিতর থেকে বাইরে না যায়, বাইরের শব্দ ভিতরে না আসে।’

যেসব সেলে তারা বন্দি ছিলেন, সেসব সম্পর্কেও সামান্য কিছু জানাতে পেরেছেন এই দুই জন। যেমন, তাঁরা জানিয়েছেন সেখানে কোনও জানালা ছিল না। ছিল দুই অংশ-সমেত একটি দরজা: একটিতে ছিল লোহার শিকের দরজা। তারপর কাঠের দরজা, যেখানে একটি ছিদ্র করা। শুধু তাই নয়, সূত্রে এও জানা যাচ্ছে,  এই দুই সামরিক কর্মকর্তা আয়নাঘরের অস্তিত্ব সম্পর্কে ওই বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে নিশ্চিত করার পাশাপাশি এঁদের একজন এই কারাগারের কয়েকটি ছবিও আমাদের সরবরাহ করেন। যা এঁদের বক্তব্যের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়।

বর্তমানে যাঁরা আটক রয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন এঁদের মধ্যে দুজনকে ২০১৬ সালের অগাস্টে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ধরে নিয়ে যায়। এদের একজন হলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতে ইসলামীর নেতা মীর কাসেম আলির ছেলে মীর আহমেদ বিন কাসেম। আরেকজন হলেন আবদুল্লাহিল আমান আযমী, যিনি নিজেও সেনাবাহিনীর একজন সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। আযমী হলেন জামায়াতে ইসলামির প্রাক্তন প্রধান গোলাম আযমের ছেলে। গোলাম আযমও একই আদালতে দণ্ডিত হয়েছিলেন। মীর আহমেদ বিন কাসেম ও আবদুল্লাহিল আমান আযমীকে আয়নাঘরে দেখেছেন এমন দুই কর্মকর্তা বিষয়টি বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থাকে নিশ্চিত করেছেন বলেই সূত্রে খবর। এমনকি হাসিনুর রহমান যখন বন্দি ছিলেন তখন তিনিও আয়নাঘরে তাঁকে দেখেছেন বলেই জানা গেছে। তাদেরকে রুটিনমতো টয়লেটে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বে যেসব প্রহরীরা ছিলেন, তাদের বিভ্রান্তির কারণে হাসিনুর টয়লেটে আযমীকে দেখে ফেলেন। পরবর্তীতে তিনি সেখানে কর্মরত এক বেসামরিক প্রহরীর মাধ্যমে বিষয়টি আরও নিশ্চিত হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

5 + two =