শুভমানের অতিমানবিক ইনিংস, দীপের পারফর্ম্যান্স ছুঁল আকাশ

প্রথম টেস্টে সেঞ্চুরি। দ্বিতীয় টেস্টে আরও এক পা এগিয়ে। ডাবল হান্ড্রেড। এটাই শুভমান গিলের টেস্টে প্রথম দ্বিশতরান। অন্যপ্রান্ত থেকে যখন উইকেট পড়ছে, তখন গিল যেন একা কুম্ভ রক্ষা করছেন ভারতের গড়।এটা বললে বোধহয় খুব একটা ভুল বলা হবে না যে, শুধু গিল ক্রিজে ছিলেন বলেই ভারত রানের শিখরে চড়তে পেরেছে।

প্রথম দিনের শেষে শুভমনের রান ছিল ১১৪। তখন তাঁর সঙ্গী হিসেবে  রবীন্দ্র জাদেজা অপরাজিত ছিলেন ৪১ রানে। ভারতের রান ছিল পাঁচ উইকেটে ৩১০। এরপর গিলের সেই ব্যাটিং দাপট অব্যাহত দ্বিতীয় দিনেও। লাঞ্চের সময়ে ভারতের রান ছিল ৬ উইকেটে ৪১৯। হতভাগ্য জাদেজা । টংয়ের বিষাক্ত বাউন্সার থেকে নিজেকে সরাতে না পেরে ৮৯ রানে ফিরতে হয় তাঁকে। তার আগে অবশ্য অধিনায়ক গিলের সঙ্গে ২০৩ রানের পার্টনারশিপ গড়েন। জাদেজার ৮৯ রানে সাজানো ছিল ১০টি চার ও একটি ছক্কা। সেঞ্চুরি হয়তো আসেনি, কিন্তু তাঁর ক্যাপ্টেনকে নিশ্চিন্তে ডাবল সেঞ্চুরির দিকে এগোনোর রাস্তাটা জাডেজাই দেখিয়েছেন। তিনি উল্টোদিকে স্কোরবোর্ড সচল রেখেছিলেন বলেই নিশ্চিন্তে ঝুঁকিহীন ব্যাটিংটা করে যেতে পেরেছেন শুভমান।

লাঞ্চের সময়ে গিল অপরাজিত ছিলেন ১৬৮ রানে। লাঞ্চের পর গিল আরও পরিণত। ইংল্যান্ডের বোলারদের রীতিমতো শাসন করে ডাবল হান্ড্রেড সেরে ফেলেন। আগের টেস্টে ৪৩০৩ থেকে ৪৭১ রানে ভেঙে পড়েছিল টিম। সেই ছবিটা এজবাস্টনে বদেল দেওয়ার পিছনে প্রথম নাম যদি অতিমানবিক শুভমান হয়, সঙ্গে দোসর হিসেবে অবশ্যই থাকবেন রবীন্দ্র জাডেজা ও ওয়াশিংটন সুন্দর। আর প্রথম ইনিংসের শেষে শুভমান, যশস্বী, জাদেজা আর ওয়াশিংটন সুন্দরের হাত ধরেই ভারতের কাছে ৫৮৭ রানের পুঁজি

এরপরই বোলিংয়ে নতুন ডিউকস বল হাতে আকাশসিরাজ জুটি ধস নামালেন ইংল্যান্ডের টপ অর্ডারে। ইংল্যান্ডের ভাঙনের শুরু চার নম্বর ওভারে। ইংল্যান্ড ইনিংস থিতু হওয়ার আগেই গত টেস্টের নায়ক বেন ডাকেটের () উইকেট। দুর্ধর্ষ ক্যাচ শুভমানের, বোলার বাংলার আকাশ দীপ। এদিকে প্রথম ওভারটায় সামান্য নড়বড়ে লেগেছিল কিন্তু দ্বিতীয় ওভারেই লাল রঙের ডিউকস বল হাতে দীপের পারফরম্যান্স আকাশছোঁয়া। প্রথমে ডাকেট, পরের বলেই ফোর্থ স্টাম্প লাইনে নিখুঁত আউট সুইংয়ে ফর্মে থাকা অলি পোপের () উইকেট। স্লিপে ক্যাচ রাহুলের। এরপর হ্যাটট্রিক বলটা সামলে দেন জো রুট (ব্যাটিং ১৮) সঙ্গী ব্রুক (৩০ ব্যাটিং)। তবে এজবাস্টনের উইকেট এখনও চমৎকার ব্যাটিং উইকেট তবে প্রায়  টানা দুটো দিন ফিল্ডিংয়ের পরে শেষ সেশনে ৫৮৭ রানের বোঝা মাথায় নিয়ে নামাটা কোনও টিমের পক্ষেই কখনওই সহজ নয়। তার উপরে নতুন ডিউকস বলে অসামান্য হয়ে উঠেছেন সিরাজ আর আকাশ।সিরিজ়ের প্রথম টেস্টে খেলেননি আকাশ, খেলেছিলেন প্রসিধ। সিরাজের সঙ্গে নতুন বলটা প্রসিধকে না দিয়ে আকাশকে দেওয়ার মধ্যে ঝুঁকি ছিল। কিন্তু সেটাই দিনের শেষে ক্যাপ্টেন শুভমানের মাস্টার স্ট্রোক।

আকাশের সঠিক লেংথই ছিল চাবিকাঠি। এখানেই সফল আকাশ দীপ। দ্বিতীয় ওভার থেকেই অভ্রান্ত লেংথে বল রেখে ঠিক সময়ে বাঁক খাইয়ে ব্যাটারকে ভুল করতে বাধ্য করেছিলেন আকাশ। অন্য ওপেনার জ্যাক ক্রলিকে ফেরান সিরাজ। বুমরাহীন ভারতের এক নম্বর অস্ত্র, যিনি একবার ছন্দ পেয়ে গেলে প্রতিপক্ষ ব্যাটিংকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ক্ষমতা রাখেন তার ইঙ্গিত ফের একবার দিয়ে রাখলেন এজবাস্টনের দ্বিতীয় দিনে। ব্যাটিং আর বোলিংয়ের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিল নির্ভুল স্লিপ ক্যাচিং। তিনটে ক্যাচই স্লিপে।

তবে এদিন বোঝা গেল কেন পরিবর্তন ভারতীয় দলে। এজবাস্টনের দ্বিতীয় দিনে সপ্তম উইকেটেও শুভমানের সঙ্গে লম্বা জুটি ওয়াশিংটনের। ঠিক যে কারণে কুলদীপের জায়গায় তিনি টিমে। সোজা ব্যাটে খেলেন, মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৫০ রানের দামি ইনিংস খেললেও সেই ম্যাচ হয়তো বাঁচেনি তবে এদিনের এই ৪২ তার চেয়ে কিছু কম দামি নয়। সপ্তম উইকেটে শুভমানওয়াশিংটনের জুটিতে আসে ১৪৪। এরপরেও শেষ তিন উইকেটে এসেছে আরও ২৯রান। হেডিংলেতে উইকেট ছোড়ার প্রায়শ্চিত্ত যেন করল লোয়ার অর্ডার।

তবে সব ছাপিয়ে নায়ক অবশ্যই ভারতীয় ক্যাপ্টেন। প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসে ১৪৭ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসের করেছিলেন মাত্র ৮ রান। এদিকে হেডিংলিতে সেঞ্চুরির পরে গিলকে নিয়ে পরিকল্পনা করে রেখেছিল ইংল্যান্ড। গত ১৬ বছরে কোনও ব্যাটসম্যানের বিরুদ্ধে এতটা সোজা বল করেননি ইংল্যান্ডের বোলাররা। তাঁকে এলবিডব্লিুউ করতে চেয়েছিলেন ইংল্যান্ডের বোলাররা। দ্বিতীয় দিনও একই রণকৌশল নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু গিল যে অন্য ধাতুতে গড়া ব্যাটসম্যান। যত সময় গড়াচ্ছে, ততই তা প্রমাণ হচ্ছে। হেডিংলেতে ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় টেস্ট কথা দিয়েছিলেন পারফর্ম করার। কথা দিয়ে কথা রাখলেনও তিনি। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ১৫০ রান মিস হওয়ার আক্ষেপ ছিল। তবে  এজবাস্টনে সেই আক্ষেপ শুধু মেটালেন না শুভমান, তিনি তৃতীয় ভারতীয় হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরিও করলেন এবং ইংল্যান্ডের মাটিতে অধিনায়ক হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরিও করলেন।এককথায় ক্যাপ্টেনস্ নক। দক্ষতার সঙ্গে যে ভাবে ইনিংস টানলেন, তাতে এটা নিশ্চিত ভাবে বলাই যায়, তিনি না থাকলে ভারতের ইনিংস গুটিয়ে যেতো আরও কম রানে। শুধু তাই নয়,  ২৬৯ রানের ওই অতিমানবিক ইনিংসের পরেও ফিল্ডিংয়ের সময়ে মাঠে তাঁকে অক্লান্ত দেখিয়েছে। হ্যারি ব্রুক যখন সিরাজকে স্টেপ আউট করে মাঠের বাইরে ফেলে দেন, স্লিপ থেকে দৌড়ে বোলারের কাছে পৌঁছে যেতে দেরি হয়নি শুভমানের। শুধু শুভমান-ই নন, গোটা ভারতীয় টিম প্রথম টেস্টের বদলা নিতে যে মুখিয়ে রয়েছে তা তাঁদের শরীরী ভাষায় স্পষ্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

13 − four =