পথ কুকুরদের নিয়ে বন্ধ হোক সামাজিক মেরুকরণ

পথ কুকুর এই মুহূর্তে এক জ্বলন্ত সমস্যা কলকাতাবাসীর প্রত্যেকের কাছেই। প্রত্যেকের কাছেই এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করার কারণ, এই ইস্যুতে কলকাতাবাসীর মধ্যে রয়েছে এক সুস্পষ্ট মেরুকরণ। একদল কুকুর একেবারেই পছন্দ করেন না। আর ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে যাঁরা কুকুরপ্রেমী। উভয়ের কাছেই এটা এক বড় সমস্যা কেন, তা এবার আরও একটু খোলসা করে বলা যাক। আজকাল কুকুর যদি কাউকে কামড়ায় সেটা সঙ্গে সঙ্গে চলে আসে সংবাদ শিরোনামে। খবর পড়ে মনে হয় হঠাৎ যেন প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ডায়ানোসর নেমে এসেছে কলকাতায়।  কোনও মহিলার শ্লীলতাহানি করা হলেও বোধহয় এতো বড়ো খবর হয় না। সত্যিই তো, শ্লীলতাহানি তো রোজ ঘটছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু কুকুর কামড়াবে কেন মানুষকে? তাকে লাথি,ঝাঁটা যাই মারা হোক (এমনকি পাথর দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হলেও) কুকুর কেন মানুষকে কামড়াবে তা নিয়ে তোলপাড় হতে থাকে সোশ্যাল মাধ্যম থেকে আমাদের মিডিয়ার একাংশ। কোনওভাবেই খতিয়েও দেখা হয় না, কেন কামড়াতে গেল কুকুরটা হঠাৎ তা নিয়েও। আর কুকুরে কামড়ের ঘটনা জানতে পারলে মিডিয়ার একাংশও যেন উল্লসিত হয়ে ওঠে। কারণ, এই সারমেয়কুলের বিরুদ্ধে একটা অস্ত্র তাঁরা হাতে তো পেয়েছেন। তাকে কাজে লাগাতেই হবে। আদতে এঁরা অনেকেই জানেন না যে মানুষের সবথেকে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে চিরকাল কেন কুকুরকে গণ্য করা হয়েছে। তাহলে এতদিন ধরে যে কথাটা চলে আসছে তা ভুল। যাঁরা তাঁদের লেখনি উঁচিয়ে এই সারমেয়কুলকে আক্রমণ করার জন্য তৈরি হন তাঁদের বোধহয় জানা নেই যে, সারাবিশ্বে সব পুলিশবাহিনীতে কেন ‘ডগ স্কোয়াড’ থাকে। এখানে পথ কুকুর নিয়ে যাঁরা ভীত হয়ে থাকেন তাঁরা বলতেই পারেন বিদেশি কুকুর আর নেড়ি কুকুরে বিস্তর তফাৎ। তাদের ইন্টেলেকচুয়্যাল লেভেল আলাদা। খুব দুঃখের সঙ্গে এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, ঘটনা মোটেই তা নয়। বরং উল্টো বললেও ভুল হবে না।

আচ্ছা এই কুকুরদের বিরুদ্ধে কলম তোলার আগে কখনও কী ভেবে দেখা হয় কেন হঠাৎ কামড়াতে গেল ওই চারপেয়েটি। ক্রমাগত অত্যাচার সইতে না পরে হয়তো প্রতি আক্রমণে যেতে বাধ্য হয়েছে সে এমনটা কেন ভাবা হয় না। কেন ভাবা হয় না যে কোনও কুকুরের বাচ্চাকে কেউ আক্রমণ করতে গেছেন, যেকারণে রুখে দাঁড়িয়েছে মা কুকুরটি। একটা কথা খেয়াল রাখতেই হবে, মানুষেরও যেমন একটা সমাজ রয়েছে ঠিক তেমনই ঠাস বুনোটে বাঁধা থাকে কুকুরদের পরিবারও। এই অমোঘ সত্যটা একমাত্র তাঁরাই জানেন, যাঁরা এই কুকুরদের অত্যন্ত কাছ থেকে নিরীক্ষণ করেছেন। কোনও মানুষকে নিরন্তর আক্রমণ করা হলে তিনি কি ছেড়ে দেন, (একেবারে যদি মেরুদণ্ডহীন না হন)? আর এটাও হতে পারে না যে খামোখা একটি কুকুর এসে কামড়ে দিল একজনকে। কুকুর -মানুষের এমন অহি-নকুল সম্পর্ক থাকলে প্রতিদিন কত সংখ্য়ক মানুষ কুকুরের কামড় খেতেন তা বিচার্যের বিষয়। অর্থাৎ, কুকুর কামড়ের আগে জানা দরকার ঘটনার প্রেক্ষিত কি।

আজকাল এই পথ কুকুরদের নিয়ে এগিয়ে আসছেন অনেক সেচ্ছ্বাসেবী সংস্থাই। এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মকর্তাদের বক্তব্য শোনার জন্য অধীর আগ্রহে থাকেন সংবাদ মাধ্যমের প্রায় প্রত্যেকেই। সেক্ষেত্রে একটা কথা এই সব কর্মকর্তাদের মাথায় রাখা বিশেষ ভাবে প্রয়োজন, তা হল যা তাঁরা বলতে চান এবং তাঁরা যা বলছেন তার মধ্যে যেন ফারাক না থাকে। দ্বিতীয়ত, কুকুরদের সম্পর্কে বক্তব্য রাখার আগে তাদের কতটা কাছ থেকে দেখে সম্ভব হয়েছে সেটাও অত্যন্ত জরুরি। কারণ, একটা কথা মনে রাখতেই হবে, প্র্যাকটিক্যাল এবং থিওরির মধ্যে তফাৎ বিস্তর। সুতরাং এমন কোনও বক্তব্য পেশ করা উচিত না যা এই অবলা প্রাণীগুলোর পক্ষে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াবে।

এই প্রসঙ্গে একটা কথা না বলে পারছি না, তা হল আমাদের রাজ্যে সরকারের এই পথ কুকুরদের পরিচর্যার ক্ষেত্রে তেমন কোনও পরিকাঠামো নেই। এরা অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের শ্রুশ্রূষা করে ঠিক করার মতো যে পরিকাঠামো পুরসভার হাতে রয়েছে তা অপ্রতুল। আর এখানেই এই পথ কুকুরদের পাশে দাঁড়ানোর দরকার মানুষের। কারণ আমাদের হাতে রয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং আরও অনেক কিছুই। সেখানে একটা অসুস্থ কুকুর ছানাকে বাঁচিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরই। কারণ, প্রকৃতিগত ভাবে রুগ্ন কুকুর ছানাকে ত্যাগ করে তার মা। এটুকু আমরা না করতে পারলে আমরা  সর্বোৎকৃষ্ট জীব বলে যে দাবি করি সে অধিকারে প্রশ্নচিহ্ন পড়তে বাধ্য। এখন অনেকেই বলে থাকেন প্রকৃতির হাতে সব কিছুকে ছেড়ে দিতে। কিন্তু সত্যিই কি তাই! আমরাও তো প্রকৃতিরই অংশ। তাহলে আমাদের জন্মের পরও তো প্রকৃতির কাছ থেকে যেটুকু পাওয়া উচিত সেটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত ছিল। বাস্তবে তা তো ঘটে না। ফলে আমাদের একটু হলেও সহানুভূতিশীল হতেই হবে এই পথ কুকুরদের উপর।

পাশাপাশি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আইআইএসআই-এর অ্যাসিসিয়েট প্রফেসর অনিন্দিতা ভদ্র, তা হল শিশুরা কুকুর ছানা দেখলে তাদের ধরে বাড়িতে নিয়ে আসে। দুদিন বাদে মোহ কাটলে রাস্তাতেই ছেড়ে দেয়। এর জেরে নিজের মাকে নে পেয়ে বেঘোরে প্রাণ যায় এই কুকুর ছানার। এই ঘটনা বন্ধ করতেই হবে। আর তা জন্য এগিয়ে আসতে হবে সচেতন নাগরিকদের।  আর কুকুরদের নিয়ে নিজেদের মধ্যে এই মেরুকরণ না ঘটিয়ে এগিয়ে আসা যাক না হাতে হাত রেখে। তাতে বাঁচানো যাবে কয়েকটি প্রাণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

9 − 6 =