নানা কারণেই স্বপ্নিলকে ঘিরে স্বপ্ন দেখা শুরু হয়। ২৮ বছরের শুটার শুরু থেকেই ৫০ মিটার থ্রি পজিশন বা থ্রি-পি ইভেন্টে সেরাটাই দিয়ে আসছেন। ৫৯০ মেরে ফাইনালে উঠেছিলেন। এতদিন একটা দুঃখ ছিল তাঁর, বারবার মেগা ইভেন্টে চতুর্থ হয়েই ফিরতে হয়। এশিয়ান গেমসে চতুর্থ হয়েছিলেন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও তাই। প্যারিস অলিম্পিকে সেই বাধা টপকানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। পয়েন্ট টেবলে ৬ থেকে ৫ হয়ে ৪-এ উঠেও কিন্তু নিজের ফোকাস সরাননি পদক থেকে। প্রোনে দুরন্ত পারফরম্যান্সই এবার পদক দিয়ে গেল তাঁকে।
প্রথম ভারতীয় হিসেবে রাইফেল থ্রি পজিশনের ফাইনালে জায়গা করে নিয়েছিলেন স্বপ্নিল কুসালে। যোগ্যতা অর্জন পর্বে দুর্দান্ত পারফর্ম করেছিলেন। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে রুপোও এনেছেন। অলিম্পিকে অবশ্য অভিষেক হল তাঁর।
স্বপ্নিলের উঠে আসা স্বপ্নেরই মতো। কৃষক পরিবারে জন্ম। বাবা ও ভাই স্কুলের শিক্ষক। মা কোলাপুরের কাম্বেলওয়াড়ি গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান। আর স্বপ্নিল পেশায় রেলের টিকিট চেকার। আর এখানেই মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে তাঁর মিল দেখেন অনেকেই। ধোনিও টিকিট চেকার ছিলেন প্রথম জীবনে। ২০১৩ সাল থেকে শুরু শুটিং। বাবাই মহারাষ্ট্রের স্পোর্টস প্রোগ্রামে দিয়েছিলেন ছেলেকে, যাতে অন্য ভাবে সাজাতে পারেন জীবন। বাবাকে নিরাশ করেননি স্বপ্নিল। ২০১৫ সাল থেকেই নজরে পড়ে যান। শুটিংয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়নও হয়েছেন। এবার ঝুলিতে অলিম্পিক পদক।
এই ইভেন্টকে ম্যারাথন অফ শুটিং বলা হয়। নিলিং, প্রোন ও স্ট্যান্ডিং পজিশনে শুট করতে হয় থ্রি পি বলা হয় এই ইভেন্টকে। ৬০ শটের ম্যাচে একবার মনোসংযোগ নষ্ট হলেই বিপদ। নিলিং বা হাঁটু মুড়ে বসে তিন সিরিজে স্বপ্নিল মারলেন ৫০.৮, ৫০.৯ এবং ৫১.৬। শুরুটাই একটু খারাপ ছিল। ৯.৬ মেরে শুরু করেন। পরের সিরিজেও একটা শটে ৯.৯ মারেন। তবে তৃতীয় সিরিজে ফিরে আসেন প্রবল ভাবে। প্রোন বা শুয়ে কিন্তু স্বপ্নিল নিজেকে মেলে ধরলেন। নিলিং সিরিজের শেষ ছয়ে ছিলেন। আর প্রোনের প্রথম সিরিজের পাঁচটা শটই মারেন ১০ পয়েন্টের উপরে। দ্বিতীয় সিরিজে প্রথম শটটাই আবার ১০.৮ মারেন কোলাপুরের ছেলে। প্রথম সিরিজে মেরেছেন ৫২.৭। দ্বিতীয় সিরিজে এল ৫২.২। তৃতীয় সিরিজে তোলেন ৫১.৯। তিন ইভেন্টের কম্বিনেশন এই থ্রি পজিশনে সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট আসে প্রোন থেকেই। ফোকাস একবারের জন্য নড়েনি তাঁর। ৬ থেকে পাঁচে উঠে পড়েন স্বপ্নিল।
স্ট্যান্ডিং বা দাঁড়িয়ে ৫১.১ মারলেন প্রথম সিরিজে। আর দ্বিতীয় সিরিজে এল ৫০.৪। তবে স্ট্যান্ডিংয়ের দ্বিতীয় সিরিজে স্বপ্নিল একটু খারাপ ফলই করলেন। চাপের মধ্যে ৯.১ মারলেন। না হলে দুয়েই থেকে যেতে পারতেন ভারতের ছেলে। এলিমিনেশন রাউন্ডের প্রথম শটটাই মারলেন ১০.৫। কিন্তু ফারাকটা কমাতে পারলেন না দ্বিতীয় শটটা ৯.৪ মারার জন্য। অবশ্য তৃতীয় শটটা ৯.৯ মারলেও তখনই পদক নিশ্চিত হয়ে যায় ভারতের। তবে স্বপ্নিল এগোতে পারতেন আরও কিছুটা। সেটা হল না শেষ শটটা ১০ পয়েন্টে শেষ করায়।
(নিলিং পজিশন) হাঁটু মুড়ে বসা, প্রোন পজিশন (শুয়ে) এবং স্ট্যান্ডিং পজিশনে ৫ শটের তিন সিরিজ। এরপর এলিমিনেশন রাউন্ড শুরু। নিলিং পজিশনে প্রথম পাঁচ শটের সিরিজে ৫০.৮ পয়েন্ট নিয়ে সপ্তম স্থানে ছিলেন স্বপ্নিল। দ্বিতীয় পাঁচ শটের সিরিজের পর ১০১.৭ পয়েন্ট নিয়ে ষষ্ঠ স্থানে উঠে আসেন। তৃতীয় পাঁচ শটের সিরিজের পর ১৫৩.৩ পয়েন্ট নিয়ে ষষ্ঠ স্থান ধরে রাখেন স্বপ্নিল।
সাত মিনিটের চেঞ্জওভার ব্রেক। এরপর প্রোন পজিশন শুরু হয়। আবারও পাঁচ শটের তিন সিরিজ। এই পজিশনেই যতটা সম্ভব বেশি পয়েন্ট জমানোয় নজর থাকে শুটারদের। প্রোন পজিশনের প্রথম পাঁচ শটের সিরিজের পর ২০৬ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম স্থানে উঠে আসেন স্বপ্নিল কুসালে। দ্বিতীয় সিরিজের পর ২৫৮.২ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম স্থানই ধরে রাখেন। এই পজিশনের তৃতীয় তথা শেষ সিরিজ শুরু হতেই চাপও বাড়তে থাকে। প্রোন পজিশন শেষে ৩১০.১ পয়েন্ট নিয়ে পঞ্চম স্থানেই স্বপ্নিল।
নয় মিনিটের চেঞ্জ ওভারের পর শুরু স্ট্যান্ডিং পজিশন। টেবলে তৃতীয় স্থানে থাকা প্রতিপক্ষর সঙ্গে ১.১ পয়েন্টের পার্থক্য় ছিল স্বপ্নিলের। ক্রমশ উন্নতি করেন। স্কোরবোর্ড বারবার বদল হতে থাকে। চতুর্থ স্থানে উঠে আসেন স্বপ্নিল। ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমীদের প্রত্যাশা বাড়তে থাকে। স্ট্যান্ডিং পজিশনে পাঁচ শটের তিন সিরিজের পর তৃতীয় স্থানে উঠে আসেন স্বপ্নিল। প্রথম এলিমিনেশনে দুই শুটার ছিটকে যান। এ বার সিঙ্গল শটে এলিমিনেশন। ৬ জনের মধ্যে প্রতিযোগিতা। ষষ্ঠ স্থানে থাকা ফ্রান্সের লুকাস ছিটকে যান। বাকি থাকেন পাঁচ শুটার। স্বপ্নিল তখনও তৃতীয় স্থানেই। শট ৪২-তে পঞ্চম স্থানে থাকা শুটার ছিটকে যাবেন। নরওয়ের জন হেগ শুরু থেকে শীর্ষে থেকে ৪২ শটের পর ছিটকে যান। তৃতীয় স্থান ধরে রাখেন স্বপ্নিল। চারজনের প্রতিযোগিতা হয়ে দাঁড়ায়। ৪৩ শটের পর চেকিয়ার প্রতিযোগী ছিটকে যান।
স্বপ্নিলের পদক নিশ্চিত হয়ে যায়। তবে ব্রোঞ্জ পদক পজিশন থেকে উন্নতি করাই লক্ষ্য ছিল। দ্বিতীয় স্থানে থাকা প্রতিপক্ষর থেকে ০.৬ পয়েন্টে পিছিয়ে ছিলেন। যদিও পদকের রং বদলাতে পারেনননি। ব্রোঞ্জ পদক স্বপ্নিল কুশালের। ৪৫১.৪ পয়েন্ট নিয়ে ব্রোঞ্জ। প্যারিস অলিম্পিকে ভারতের তৃতীয় পদক। তিনটিই শুটিং থেকে।