শোষক জমিদারদের নিপীড়নের প্রতিবাদ আর সলিলকে একসূত্রে বাঁধল টালা ফ্রেন্ডস

আকারে ছোট পুজো। তবে উত্তর কলকাতার প্রখ্যাত পুজোর যদি একটা তালিকা তৈরি করা যায় তাহলে তার প্রায় প্রথম দিকেই থাকবে টালা ফ্রেন্ডসের অ্যাসোসিয়েশনের নাম। গত ১৮ বছর ধরে সাবেকি ঘরানার সঙ্গে থিমের এক অদ্ভুত মিশেলে পুজো করে আসছে এই টালা ফ্রেন্ডস। সাবেকিয়ানা তাদের ধরা পড়ে মাতৃ প্রতিমায় আর পুজো মণ্ডপ হয় কোনও একটা থিমকে কেন্দ্র করে। তবে ২০২৫-এর পুজোতে এই ঘরানা থেকে বেরিয়ে দর্শনার্থীদের একটু নতুন স্বাদ দিতে চাইছে টালা ফ্রেন্ডস। সেখানেও থিমের পুজো বলতে ঠিক যেটা আমরা বুঝি তা থেকে একটু ভিন্ন পথেই হাঁটতে দেখা যাবে এই টালা ফ্রেন্ডসকে। ধোঁয়াশা না রেখে একটু খুলেই বলা যাক। অন্যান্য পুজোতে আমরা প্যান্ডেলের থিমের সঙ্গে মাতৃপ্রতিমার কোথাও একটা সাজুয্য খুঁজে পাই। সেই ধরাবাঁধা পথে হাঁটতে রাজি নয় টালা ফ্রেন্ডস। কোথায় তো নিজেদের একটা স্বকীয়তা রাখতে হবে। তাই ফি- বছরের মতো প্যান্ডেলের সঙ্গে মাতৃ প্রতিমাও তৈরি হয়েছে থিমকে নির্ভর করে। তবে এই দুটো থিম বড়ই আলাদা। টালা ফ্রেন্ডসের মণ্ডপে প্রবেশ পথ থেকে মণ্ডপে পৌঁছানো পর্যন্ত কানে ভেসে আসবে প্রয়াত শিল্পী- সুরকার সলিল চৌধুরীর সুরারোপিত নানা গান। আর এই গান আপনাকে যে নস্টালজিক করে তুলবেই তা হলফ করে বলা যায়। কারণ, সলিল চৌধুরীর সে সৃষ্টি এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আর সেই কারণেই এখনও অমর হয়ে রয়েছে তাঁর সুর দেওয়া হাজারো গান। এমনকী প্যান্ডেল এবং তার ভিতরেও তুলে ধরা হবে সলিল চৌধুরীর নানা অমর সৃষ্টি থেকে শুরু করে তাঁর জীবন নিয়ে বেশ কিছু তথ্য। যেমন মণ্ডপে প্রবেশ পথেই রাখা হবে সলিলের দু’টি আঁকা ছবিও। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা শ্রেয়, সলিল খ্যাতির চূড়ায় উঠেছিলেন ঠিকই কিন্তু সে পথ মোটেই মসৃণ ছিল না। সলিলের জীবনে এসেছে নানা প্রতিবন্ধকতা। তা জয় করে তিনি এগিয়ে গেছেন তাঁর অভিষ্ট লক্ষ্যে। আর শিল্পীর জীবনের এই ওঠাপড়াকে তুলে ধরা হয়েছে এক মইয়ের মাধ্যমে। রঙিন মইয়ের মাঝে জালের ব্যবহার বুঝিয়ে দেবে তাঁর জীবনে আসা নানা প্রতিবন্ধকতাকেও। মণ্ডপে কোথাও ব্যবহার করা হবে তাঁর লেখা গানের দু-এক কলি। আবার কোথাও ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হবে তাঁর জীবনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে। একইসঙ্গে উঠে আসবে তাঁর সময়ের নানা শিল্পীর কথাও। যাঁরা তাঁর সুর দেওয়া গানে মন জয় করেছেন বঙ্গবাসীর। শুধু কী তাই, সলিলের প্রথম গানের রেকর্ডের একটি ছবিও তুলে ধরা হবে এই মণ্ডপে। খুব সহজ কথায় বলতে গেলে সলিলের মতো এমন এক বহুমুখি প্রতিভাকে সম্মান জানানো ক্ষেত্রে আর কীই বা হতে পারতো তাঁর এই জন্ম শতবর্ষে! মণ্ডপের থিমের শীর্ষক এখানে ‘অতল সলিল’। পরিকল্পনায় টালা ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশন।

এবার আসা যাক প্রতিমায়। মাতৃপ্রতিমা এবার রূপদান করা হয়েছে এক গ্রাম্যবধূর বেশে। ইংরেজ জামানায় এই গ্রামের সাধাসিধে লোকগুলোর ওপর কর আদায় নিয়ে কম নির্যাতন করেননি সেই সময়ের শোষক জমিদারেরা। সেই নিপীড়ন আর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে হন্যে হয় পথ খুঁজেছেন তাঁরা। অবশেষে গ্রাম্য বধূরাই হাতে তুলে নেন প্রতিবাদের অস্ত্র। এখানেই শুরু নারীর ক্ষমতায়নের। যার ফসল আমরা পাচ্ছি বর্তমানে। ভারতের রাষ্ট্রপতি থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর পদ অধিকার করেছেন নারীরাই। আর সেই ঘটনাই প্রতিফলিত হয়েছে  প্রতিমায়। সেখানে মা দুর্গা এবং শিবকে দেখা যাবে পাশাপাশি। কারণ, পুরুষকে চিরকালীই চালনা করছে নারী শক্তি-ই। নারীরা পাশে না থাকলে কোনও পুরুষ তাঁর সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছাতে পারেন না। অথবা আর একটু সহজ ভাবে বললে প্রত্যেক সফল পুরুষের পিছনে রয়েছে কোনও এক নারীর অবদান। সেই কারণে এখানে শিব-দুর্গা একত্রে লড়াই করছেন শোষক জমিদারের বিরুদ্ধে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই শোষক জমিদারের প্রতিভূ হিসেবে এখানে রাখা হয়েছে মহিষাসুরকে। মা দুর্গার পাশাপাশি তাঁর সন্তানদেরও উপস্থাপন করা হয়েছে কোনও এক দরিদ্র পরিবারের সন্তান হিসেবেই। আর এখানে এক অদ্ভুত ভাবেই কোথায় যেন এক মেলবন্ধন তৈরি হয়ে গেছে প্যান্ডেলের থিমের সঙ্গে প্রতিমারও। কারণ,  সলিল এমন বহু গান রচনা করেছেন যার মধ্যে এই শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর আওয়াজ উঠেছিল সোচ্চারে।

এতো গেল প্রতিমা আর থিম নিয়ে কথা। পুজোকে ঘিরে কয়েকটা দিন এক সুতোয় যেন বাঁধা পড়েন টালা ফ্রেন্ডসের সদস্যরা। সপ্তমী থেকে দশমী প্রতিটি সদস্য বাহ্যিক জগত ভুলে পড়ে থাকেন এই পুজো মণ্ডপেই। খাওয়া দাওয়ার তো সমস্যা নেই। সে দায়িত্ব তো পুজো কর্তাদের। এরপর দশমীতে হয় ‘দরিদ্র নারায়ণ সেবা’। এদিন কোনও ভেদাভেদ থাকে না কারও মাঝে। অতি দীন দরিদ্রের সঙ্গে একাসনে বসে দ্বিপ্রাহরিক আহার সারেন পুজো উদ্যোক্তারাও। সম্প্রীতির এক অনন্য নজির বললে হয়তো কম বলা হবে।

এরপর একাদশীতে মাকে বিদায় জানান, ক্লাব সদস্যরাই। এদিন টালা ফ্রেন্ডসের প্রত্যেক পুজো উদ্যোক্তা সাজেন একই সাজে। পুরুষদের এক ধরনের ‘ড্রেস কোড’ যেমন থাকে ঠিক তেমনই ‘ড্রেস কোড’ থাকে মহিলাদেরও। নিরঞ্জনের শোভাযাত্রায়  মায়ের সঙ্গে তাঁরাও ভরাক্রান্ত মনে এগিয়ে চলেন গঙ্গার দিকে। মনে মনে একটাই প্রার্থনা, ‘সবাইকে ভালো রাখিস মা, সুস্থ রাখিস। পরের বছরের জন্য পথে চেয়ে বসে রইলাম আমরা।’    

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three × 4 =