প্রযুক্তির সঙ্গে পা মেলাচ্ছেন প্রবীণেরা, প্রমাণ করল বইমেলা 

নবমীতে জনজোয়ার কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়। নবমী বলবো নাই বা কেন, রবিবার-ই যে এই বই উৎসবের অন্তিম দিন। কলকাতা বইমেলার সঙ্গে একমাত্র তুলনা চলে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজোর। কারণ, এই বইমেলার নামে ‘মেলা’ হলেও এটা আদতে বাঙালির কাছে একটা উৎসব ছাড়া আর কিছুই নয়। যেখানে সর্বস্তরের বাঙালি অংশ নেন মনেপ্রাণে। আর সেই কারণেই বাঙালির ‘বারো মাসে তেরো পার্বন’ এই আপ্তবাক্যে পরিবর্তন এনে বইমেলা তা করেছে ‘বাঙালির বারো মাসে চোদ্দ পার্বন’।
বাঙালির বইপার্বনে অধিকাংশ বাঙালি থেকে অবাঙালি প্রত্যেকেই অংশ নিলেও মন খারাপ কিন্তু একটা অংশের। আর তারা হলেন যাদের জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষার শুরু এই বইমেলা শেষ হওয়ার পরদিন থেকেই। প্রতিবছরই বইমেলা এমন এক সময় হয় যাতে সমস্যায় পড়েন মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা। আর এখানেই তাঁদের এক বিরাট আপত্তি এই বইমেলার নির্ঘণ্ট নিয়ে। এই বইমেলা কী পরীক্ষার আরও বেশ কিছুটা আগে বা পরে করা যায় কি না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। এদিকে  পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ডের সভাপতি ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় এ ব্যাপারে জানান, কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার সূচির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিশ্বের অন্যান্য বইমেলার সূচিও। গোটা বিশ্বে যত আন্তর্জাতিক বইমেলা হয় প্রত্যেকটির সূচি নির্ধারণ করে দেয় আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার। যাতে একটার সঙ্গে অন্যটার কোনওভাবে সংঘাত না হয়। ১৯৭৬ সালে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট বইমেলা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু হয়েছিল কলকাতা বইমেলা। তবে সেই সময় আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার বানানো হয়নি। সেই সময় বইমেলা অনুষ্ঠিত হত মার্চের শুরুতে। পরে ক্যালেন্ডার মেনে সেই সূচি বদলে এগিয়ে আনা হয় জানুয়ারি মাসে। এই ট্র্যাডিশন মেনেই ১৯৮৩ সালে প্রথমবার কলকাতা বইমেলা বছরের এই সময়টায় শুরু করা হয়েছিল। তবে এখন আন্তর্জাতিক ক্যালেন্ডার মেনে চলার অতটা বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু মানুষ জানেন যে বছরের এই সময়টায় বইমেলা শুরু হবে। কলকাতা থেকে বঙ্গবাসী ছোট থেকে জেনে আসছে জানুয়ারি মাসের শেষ বুধবার থেকে কলকাতা বইমেলা শুরু হবে। সেই কারণে এটা আর বদলানো হয়নি। এর পাশাপাশি গিল্ডের তরফ থেকে এও জানানো হয়েছে যে, এই সময়টা বই মেলা করায় একটা বাড়তি সুবিধাও রয়েছে। একদিকে যেমন শীতকাল, তাতে নরম সূর্যের আলোয় এদিক-ওদিক ঘোরার যেমন সুবিধা রয়েছে ঠিক তেমনই অন্যদিকে বেশ কিছু ছুটিও থাকে বছরের এই সময়টায়। তবে এই প্রসঙ্গে গিল্ড এও মনে করিয়ে দিয়েছে,  এই সূচির কখনও অদলবদল হয়নি তাও নয়। অবশ্যই হয়েছে। ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচন ছিল। সেই কারণে বইমেলার সময়সূচিতে পরিবর্তন করা হয়। তবে এই বইমেলা যেহেতু সাধারণ মানুষের জন্য সেই কারণে তাদের কথা সবার আগে ভাবে গিল্ড।
২০২৫-এ বইমেলায় নজর কেড়েছে হাঁসের আদলে তৈরি ম্যাসকট। একজন পুরুষ এবং অন্য জন নারী। এদের দেখতে অনেকটা চশমা চোখে অতি পরিচিত এক বাঙালি পড়ুয়ার মতো। বইমেলায় আলাদা ম্যাসকট জোন তৈরি করা হয়েছিল। টি-শার্ট, কাপের মতো সামগ্রীতেও ম্যাসকটের মাধ্যমে চলেছে বইমেলার প্রচার। হাঁসকে ম্যাসকট করার কারণ, দেবী সরস্বতীর বাহন রাজহাঁস। আর এই সরস্বতীই বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী। সেই কারণেই কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় ম্যাসকট হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে দেবী সরস্বতীর বাহনকেই।আগে কখনও আন্তর্জাতিক বইমেলায় এমন ম্যাসকট ছিল কি না তা মনে করতে পারেননি কেউই।
২০২৫-এ বইমেলা প্রাঙ্গনে স্টল এক হাজারেরর একটু বেশিই। ছোট, বড় এবং মাঝারি প্রকাশক অনেকেই অংশ নিয়েছেন এবারের বইমেলায়। রয়েছে লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলও।  এর সঙ্গে নজর কেড়েছে বইমেলার ন’টি গেট। যার একটি জার্মান ভাষাবিদ ম্যাক্সমুলারের নাম এবং অন্য একটি থাকবে জার্মান লেখক গ্যেটের নামে।  জার্মানিকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়ার কারণ হল কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার থিম কান্ট্রি-ই ইউরোপের এই দেশ। এর পাশাপাশি ২৫–এর বইমেলায় উৎযাপন করা হয় সলিল চৌধুরী, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিনহা, নারায়ণ সান্যাল এবং অরুন্ধতি দেবীর জন্মশতবর্ষ। একই সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম এবং জীবনানন্দ দাশের ১২৫ তম জন্মবর্ষ পূর্তিতে তাঁদের স্মরণ করা হয় নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে।
তবে একটু একটু করে আধুনিক প্রযুক্তির আঁচ লাগছে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায়। তার জেরে বদলাচ্ছে মেলার চেহারাও। তা ভীষণভাবে মালুম হল ২০২৫-এ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা প্রাঙ্গনে পা রাখতেই। কারণ এবার নজরে এল অ্যাপের মাধ্যমে গুগল লোকেশন অনুযায়ী স্টল খুঁজে নেওয়ার মতো ঘটনা। ২০২৪-এর বইমেলাতেও যাঁরাই গেছেন তাঁদের সবার আগে লক্ষ্য ছিল গিল্ডের অফিস থেকে ম্যাপ সংগ্রহ করা। কারণ, সেই ম্যাপ দেখে পাঠক পছন্দের স্টল খুঁজে পান। তবে এবার আর কেবলমাত্র ম্যাপ দেখে স্টল খুঁজে পেতে হিমসিম খেতে হয়নি সাধারণ মানুষকে। এবার বিশেষ ধরনের অ্যাপ এনেছে পাবলিসার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড। ‘আইকেবিএফ’ নামের অ্যাপটি প্লে স্টোর থেকে ডাউনলোড করে নিলেই হল। এরপর মোবাইলে ওই অ্যাপই হদিশ দিয়েছে যে স্টলটি খোঁজা হচ্ছে তার সঠিক অবস্থান। এই প্রসঙ্গে এটা বলতেই হয়, এই অ্যাপটি তৈরি করেছে সিস্টার নিবেদিতা ইউনিভার্সিটি।ফলে বইমেলায় এখন থেকে ঢাউস ম্যাপ নিয়ে ঘোরার দিন শেষ। নয়া প্রযুক্তির ছোঁয়ায় খুশি নব প্রজন্ম, আর প্রবীণরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করছেন আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার। নয়তো পিছিয়ে পড়তে হবে যে!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

sixteen − 2 =