গড়িয়ায় বন্ধ ফ্ল্যাটের মধ্যে থেকে মিলল দম্পতি ও ছেলের ঝুলন্ত দেহ

গড়িয়া স্টেশন এলাকার একটি আবাসনের ফ্ল্যাট ৩ দিন ধরে বন্ধ। ওই বাড়িতেই থাকতেন স্বামী, স্ত্রী এবং ছেলে। এই তিনজন হলেন বছর পঁচাত্তরের স্বপন মৈত্র,  স্ত্রী বছর ৬৯-এর অপর্ণা মৈত্র ৬৯ আর ৩৯ বছরের ছেলে সুমন রাজ মৈত্র। গত শনিবার থেকে কারও দেখাও মেলেনি। বাড়ি থেকেও মিলছিল না কোনও সাড়াশব্দ। এদিকে গত তিনদিন তাঁদের আত্মীয়রা ফোন করে কোনও ভাবে সাড়া পাচ্ছিলেন না। এদিকে ওই ফ্ল্যাট থেকে বের হচ্ছে পচা গন্ধ।জানালার নেটে মাছি বসে। সময় যত গড়িয়েছে ততই বেড়েছে দুর্গন্ধের দাপট। সন্দেহ হওয়ায় প্রতিবেশীরা খোঁজ খবর শুরু করেন। বেলও বাজান। কিন্তু, কেউ সাড়া না দেওয়াতেই বাড়ে উদ্বেগ। শেষ পর্যন্ত খবর দেওয়া হয় পুলিশে। এমন খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় নরেন্দ্রপুর থানার পুলিশ।এরপর ওই ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ফ্ল্যাটে ঢুকতেই নজরে আসে তিনটি ঘরে ঝুলছে তিনজনের মৃতদেহ। ইতিমধ্যেই সেগুলিকে পচনও ধরে গিয়েছে। তারই গন্ধে ঢেকে গিয়েছিল এলাকা। এমনই ঘটনা ঘটেছে নরেন্দ্রপুর থানা এলাকার গড়িয়া স্টেশন সংলগ্ন উত্তর বালিয়ার একটি আবাসনে।

পুলিশ এবং স্থানীয়দের প্রাথমিক ধারনা তিনজনেই আত্মঘাতী হয়েছেন। কিন্তু, কেন আচমকা বাড়ির সবাই একযোগে আত্মহত্যা করতে গেলেন তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। বাড়ির কর্তা স্বপনবাবু আগে একটি বেসরকারি সংস্থায় ইঞ্জিনিয়র ছিলেন। তবে কিছুদিন আগে থেকে তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়েছিলেন। বছর দেড়েক আগে তাঁর হার্টের বাইপাস সার্জারি হয়। তাঁর স্ত্রী অপর্ণা দেবীও অসুস্থ ছিলেন। এদিকে আবার বেশ কিছুদিন ধরে পরিবারটি আর্থিক অনটনে ভুগছিল বলেও জানা গিয়েছে। ছেলে সুমন রাজ সেরকম ভাবে কিছু কাজকর্ম করত না। যার ফলে সংসারে আর্থিক অভাব ছিল। সংসারের পেছনে বেশ খানিকটা সাহায্য করতেন অপর্ণা দেবীর ভাই দেবাশিস ঘোষ। দেবাশিসবাবু তিন দিন আগে বেড়াতে গিয়েছিলেন। দু-থেকে তিন দিন দেবাশিসবাবুও কোনও ভাবে ফোনে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না ওদের সঙ্গে।

ঘটনার খবর পেয়ে বুধবার সকালেই দেবাশিসবাবু ঘটনাস্থলে আসেন।, দেবাশিসবাবু জানান, ‘দিদি জামাইবাবু ২ জনেই অসুস্থ ছিলেন। জামাইবাবুর কয়েক বছর আগে বাইপাস সার্জারিও হয়। তারপর থেকে শরীরটা বিশেষ ভাল ছিল না। ওদেরকে দেখার জন্যই আমার ভাগ্নে পুরোপুরি বাড়িতে থাকত। আমি তো শেষ ২৮ তারিখ এসেছিল। তখনও কিছু বুঝিনি। কোনও অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি। নিজের হাতে কেক বানিয়ে খাইয়েছিল আমার ভাগ্নে। আজ খবর পেয়ে এসে দেখি এই ঘটনা। কেন করল, কী করল কিছুই বুঝতে পারছি না।’

এদিকে দেহ তিনটি উদ্ধার করে পাঠানো হয়েছে ময়নাতদন্তে। মৃত্যুর পিছনে আর অন্য কোনও কারণ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। এই ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় আবাসনের অন্যান্য বাসিন্দাদেরও।

এদিকে ঘটনার তদন্তে নামতেই গত ২৮ ডিসেম্বর দুপুরে ২০ মিনিট এবং ৫৯ সেকেন্ডের দুটো ফেসবুক লাইভ এই ঘটনাকে একটা ভিন্ন মাত্রা দিচ্ছে। তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশাও। কারণ, এই দুটি ফেসবুক লাইভে মৈত্র দম্পতির ছেলে সুমনকে বলতে শোনা যায়, ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন তাঁরা। সাহায্য নেওয়ার কোনও জায়গা নেই। হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু কে বা কারা দিচ্ছে সেটা স্পট করেননি ফেসবুক লাইভে। লাইভে আরও বলতে শোনা যায়, ‘ফ্যমিলির সঙ্গে ইউটিউবে কিছু দেখছিলাম। নিজেদের মধ্যে কিছু কমেন্ট করেছিলাম। বাইরে থাকে কেউ শুনতে পেয়ে যায়। বাড়িতে দরজা ভেঙে ঢুকে আসতে চাইছে। দেখতে পেলেই মেরে দেবে। হঠাৎ করে কিছু মানুষ আমার উপরে ক্ষেপে গেছে। প্রথম দিন থেকেই কেউ কেউ আমাকে অপদস্থ অপমান করছে। আমার আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কোথায় পালাবো। আমাকে তো সেখানেও ধরবে। আমাকে তো বোঝাতে পারতো। মামাকে জানিয়েছি। মামা ব্যবস্থা করবে বলছে। কিন্তু কিছু লোকজন পাগল পাগল বলছে। এমনকি ফেসবুক লাইভে শেষের দিকে বলছেন, ভাবছি এবার নিজেকে শেষ করে দেব। বাবা, মাকে শেষ করে ফেলতে ইচ্ছা করছে।’

এই সব তথ্য দেখেই পুলিশের অনুমান মানসিক অবসাদের জায়গা থেকে বাবা-মাকে খুন করে নিজে আত্মঘাতী হয়ে থাকতে পারেন সুমন। ইতিমধ্যেই পুলিশ সুমনের মোবাইল ফোনও বাজেয়াপ্ত করেছে। সুমনের এই ফেসবুক লাইভের কনটেন্টের কোনও যথার্থতা আদতে আছে কি না তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। মানসিক অবসাদ ও অসুস্থতার কারণেই এ ধরনের কথা তিনি বলছেন কি না সেটাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ। যদিও এদিন মৃতের মামাকে এই ফেসবুক লাইভ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

two × two =