ভোটের রেজাল্ট যে এভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে যাবে তা অনেকেই ভাবেননি। অনেকেই ভেবেছিলেন যেভাবে খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি ওরা করেছে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও তাতে তাদের আসন সংখ্যা আরও বাড়বে। তবে নো ভোট টু বিজেপি প্রচারটা কিছুটা কাজ করেছে বলে মনে হচ্ছে, অন্তত শহুরে নাগরিকদের মধ্যে তো বটেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারনা, এবারে নাগরিক ভোটের একটা বড় অংশই নেগেটিভ ভোট; অর্থাৎ তৃণমূল ভোট পেয়েছে তাদের প্রতি শহুরে নাগরিকদের প্রবল ভালোবাসার কারণে নয়, ভোটটা আসলে পড়েছে বিজেপির বিপক্ষে।
এদিকে কতকগুলো বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে, বিশেষত কটি ছেলেমেয়ে, যেমন মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, ঐশী ঘোষ, দীপ্সিতা ধর, সায়ন বন্দ্যোপাধ্যায়, সৃজন ভট্টাচার্যের কথাবার্তা, রাজনৈতিক বোধ এমনকি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে এঁরা সততার সঙ্গে রাজনীতি করছেন এবং মানুষের জন্য কাজ করবেন বলেই ময়দানে নেমেছেন। আর এখানেই প্রশ্ন, সংসদীয় বামপন্থী নেতৃত্ব কোনও প্রস্তুতি না নিয়ে এইসব বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কিসের মুখে ঠেলে দিলেন? এই উজ্জ্বল তেজী ছেলেমেয়েদের তাঁরা নামিয়ে দিলেন এমন এক পরিস্থিতিতে যেখানে একদিকে রয়েছে বিজেপির মতো একটি চরম সাম্প্রদায়িক শক্তি, অন্যদিকে তৃণমূলের নোংরামি, গুণ্ডামি, অসভ্যতা, অসাংস্কৃতিক আচরণ। তাঁদের বলা হল এই দুটোকেই তোমাদের ঠেকাতে হবে। সেটা কি আদৌ সম্ভব ছিল? এই ছেলেমেয়েরা জানপ্রাণ লড়িয়ে কাজ করেছে, তা দেখেছি। ময়দানে নেমে মানুষের সঙ্গে মিশে কাজ করেন এমন ঘনিষ্ঠ মানুষজনের মধ্যেও এঁদের প্রতি উচ্ছ্বাস দেখেছি, কিন্তু এই ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি তঁদের নেতৃত্বের পক্ষ থেকেই সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করা হল। কারণ তাঁদের নেতারা তাঁদের সামনে আর কোনও বিকল্প রাখেননি, হয় ভোটে জেতো নতুবা পেরিশ।
বামপন্থী নেতৃত্বের ভুল যে শুধু এই একটা তা নয়। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন হয়ে এবার অর্থাৎ ২০২১-এর ভোটে— বামপন্থীদের ধারাবাহিক ভোটক্ষয়ের আরও একটা বড় কারণ তাঁরা নিজেদের ভোট বিজেপিকে হস্তান্তর করার এক ভয়ঙ্কর ও আত্মঘাতী স্ট্র্যাটেজিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, মার্ক্সবাদের দোহাই দিয়ে তাঁরা বলছেন, স্ট্র্যাটেজি আর ট্যাক্টিক্স, এগুলো তো মার্ক্সবাদের একটা প্রধান অঙ্গ; তাঁরা ট্যাক্টিক্স হিসেবে ওই পন্থা নিয়েছিলেন। সংসদীয় অর্থে তাঁদের প্রতিপক্ষ যেহেতু শাসক তৃণমূল, তাই তাঁরা বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাবেন। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও তাঁরা যে গোপনে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর সেই কারণেই খুব ঢেঁড়া পিটিয়ে না বললেও ২০১৯-এ তো দেখা গেছে যে স্ট্র্যাটেজি নেওয়া হয়েছিল এবার বিজেপি আসুক, এর পরের নির্বাচনে বিজেপিকে সরিয়ে আবার রাজ্যের ক্ষমতা দখল করা যাবে। আর তা ছিল বামপন্থীদের জনবিচ্ছিন্নতার চরম পর্যায়। কখনও কোনও সংসদীয় বামপন্থী দল এর আগে এমন চরম মূর্খামির পরিচয় দিয়েছে বলে অনেকেই মনে করতে পারছেন না। পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের অনেক দোষ-ত্রুটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সে কার না আছে। কিন্তু তাঁরা তো সারাক্ষণই হিমালয়ান ব্লান্ডারের কথা বলেন, এটা তাঁদের ডাবল হিমালয়ান ব্লান্ডার৷ কেরলের সঙ্গে তুলনা করলেই সেটা বোঝা যায়। করোনার বিষয়টা যখন এল, পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা মাঠে নামলেন, সত্যি সত্যিই অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে গেলেন, কিন্তু এটা তাঁরা ক্যাশ-ইন করতে পারলেন না।
তবে বামেদের বঙ্গের রাজনীতিতে মাটি খুঁজে না পাওয়া নিয়ে বেশ কিছু তত্ত্ব সামনে এসেছে।বাম এবং কংগ্রেসের এই জোটকে মেনে নিতে পারছেন না বামেদেরই বড় একটা অংশ। সেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মানুষ মমতাকে দেখেছে। এর পাশাপাশি গ্রামের দিকে অবস্থা আরও করুন। এখানে হিন্দু মুসলমানের বিভাজন রেখাটা যে এতদিন কিছুটা হলেও অস্পষ্ট ছিল, ভোটের আগে থেকেই তা স্পষ্ট হতে শুরু করে; ফলাফলের পর তা একবার স্পষ্ট হয়ে গেল। ওখান বিজেপির ওপর তৃণমূলের আক্রমণ মাত্রই হিন্দুর ওপর মুসলমানের আক্রমণ বলে অভিহিত হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের দিকে বামেদের ভরাডুবির প্রধান কারণ হল গ্রামের মানুষের কাছে এই নির্বাচনটা ছিল তৃণমূল ভার্সেস বিজেপি বলা ভালো হিন্দু ভার্সেস মুসলিম এখানে ধর্মনিরপেক্ষতার বা বামেদের কোনো জায়গা ছিলনা। জায়গাটা তৈরি করাও সহজ ছিলনা। কেন্দ্র এবং রাজ্য– দুই সরকারই হিন্দু – মুসলিম এই দুই ধর্মের মানুষের মনে ধর্মীয় বোধ ( আসলে অপবোধ) টা এমন স্পষ্ট করে তুলেছে যে এই অপবোধ লুপ্ত করে একটা ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক বোধ জাগ্রত করা বামেদের পক্ষে সহজ ছিলনা। হয়তো এই অপবোধের ফলেই বিজেপি ও তৃণমূলের ‘ভিক্ষার রাজনীতি’ এখানে প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। তবুও “ভিক্ষার রাজনীতি”, ধর্মীয় অপবোধ, ক্যাডারদের চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করেও গ্রামাঞ্চলে যে মুষ্টিমেয় ভোট বামেরা পেয়েছে তা সমুদ্রের মাঝে ক্ষুদ্র ভূখণ্ডমাত্র। সেই ভূখণ্ডে আদম-ঈভ এর মধ্য দিয়ে এক নতুন সমাজ তৈরি হবে কিনা তা সময় বলবে।