ইস্তেহার কি পুরোটাই ভাঁওতাবাজি!

দেশজুড়ে চলছে গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় উৎসব- লোকসভা নির্বাচনে। একসময় নির্বাচনী প্রচারের প্রতিটি রাজনৈতিক দলরে তরফ থেকে তাদের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হতো ‘নির্বাচনী ইস্তেহার’ বা ‘ইলেকশান ম্যানিফেস্টো’-তে। এবারেও তার ব্যতিক্রম কিচ্ছু হয়নি। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের তরফ থেকেই জানানো হয়েছে তাদের ভোট পরবর্তী লক্ষ্যের কথা। অর্থাৎ, আগামী দিনে ক্ষমতায় এলে তারা জনগণের জন্য কী কী করবে। অথচ, এই নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে যকন দলীয় নেতারা যে ভাষণ দিচ্ছেন তাতে এই ইস্তেহারের ছিঁটেফোটার উল্লেখ নেই। বিচিত্র ঘটনা। সেক্ষেত্রে যে বক্তব্য তাঁরা রাখছেন তাতে না আছে রাজনীতি, না আছে সমাজনীতি। নেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনও দিশা কিংবা মানুষের দিনবদলের পরিকল্পনা। এখন প্রচার মানেই পারস্পরিক কুৎসা। ব্যক্তিগত স্তরে আক্রমণ। এখন একে অপরকে চোর-ডাকাত এই তকমা দিয়েই সারছেন তাঁদের ভাষণ। আর এই বাষণে কতটা সত্যতা আছে তা বিলক্ষণ জানেন আমজনতা। সঙ্গে আছে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের কথা। যেটা এখন যে কোনও রাজনৈতিক দলের ইউএসপি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পাশাপাশি ভোট পেতে কেউ স্টিং ভিডিও বানাচ্ছে, কেউ প্রতিপক্ষের ঘর পোড়াচ্ছে। ভিন্নমতের মানুষকে এলাকাছাড়া করেও ক্ষান্ত হচ্ছে না, খুন পর্যন্ত করে বসছে। আদতে এগুলো কিছুই নয়, আমজনতার দৃষ্টি ঘোরাতে সস্তা চমক মাত্র।

গত পাঁচ বছরের হিসেব করে আমজনতা যেটা বুঝতে পারছেন তাতে উন্নয়নের প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা রাজ্য সরকার কেউই কথা রাখেনি। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বাস্তবের বিস্তর ফাঁক। অন্ত পরিসংখ্যান সেই কথাই বলে। রামমন্দির তৈরি, কাশ্মিরে আর্টিকেল ৩৭০ বাতিল ছাড়া বিজেপি বাকি কোনও নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির ধার দিয়ে যায়নি। রামমন্দির প্রতিষ্ঠাকে বিজেপি ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি পূরণ বলে তুলে ধরেছে। এও এক বিজ্ঞাপন। রাজনৈতিক দলগুলোর হয়তো খেয়াল নেই, মন্দির-মসজিদ কখনও গরিবের পেটে ভাত, বেকারের হাতে কাজ দেয় না, বাসস্থানের ব্যবস্থা করে না। ২০১৯ সালে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল প্রত্যেক পরিবারের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লাখ টাকা এবং দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের শতাংশকে এক ডিজিটে নামিয়ে আনার। কোথায় সে সব প্রতিশ্রুতি। কারও অ্যাকাউন্টে একটা টাকাও ঢোকেনি। ভারতে এখনও ২৩ কোটি মানুষ দরিদ্র। ২০২৩ সালের শেষে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা ১১.২৮ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ইস্তেহারের দারিদ্র্য দূরীকরণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়নি। কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে বলা হয়েছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বছরে ২ কোটি বেকার চাকরি পাবে। কোথায় চাকরি? ২০১৯ সালে বেকারত্বের হার যেখানে ৫.২৭ শতাংশ ছিল ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তা বেড়ে হয়েছে ৮.১১ শতাংশ। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে বলা হয়েছিল ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলির প্রসার ঘটিয়ে বাড়তি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হবে। তবে এখন যেটা সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট তা হল কর্মসংস্থান নয় ইলেকটোরাল বন্ডে টাকা আদায়ের জন্যই এদের বাড়তি সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকের গড় মাসিক আয় দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। ভারতকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত করার স্বপ্নও অধরা থেকে গেছে।

এদিকে রাজ্যে, সরকার চালাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ১০০ দিনের কাজকে ২০০ দিনের করা হবে সঙ্গে দৈনিক মজুরি দ্বিগুণ। সেই ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণিত করতে ভুয়ো জবকার্ড বানিয়ে ১০০ দিনের কাজের বরাদ্দ টাকা নয়ছয় করেছে। সঠিক ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট দিতে না পারায় কেন্দ্র বরাদ্দ বন্ধ করেছে। অর্থের অভাবে রাজ্যে মনরেগার কাজ বন্ধ। মহিলাদের ক্ষমতায়ন প্রতিশ্রুতির তালিকায় জ্বলজ্বল করছে। বাস্তবে দেখা গেল মহিলাদের স্বনির্ভর না করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের দেয় ৫০০ টাকাকে বাড়িয়ে ১০০০ টাকা করতে। এতে ভোটব্যাঙ্ক নিশ্চিত হলেও নারীর ক্ষমতায়নের ঘরে কিন্তু সেই শূন্য ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। সন্দেশখালির ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে রাজ্যে মহিলাদের আত্মমর্যাদা বৃদ্ধিতে সরকারের সদিচ্ছার অভাব কতটা। যুবক ও শিক্ষার্থীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি, শুধুই কথার কথা। নইলে শিক্ষক নিয়োগে এত বড় দুর্নীতি ঘটত না। যার জেরে গোটা শিক্ষাদপ্তর জেলে। কৃষকদের ফসলের সঠিক দাম নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দেওয়ার কথা ছিল। রাজ্যের কৃষকদের পিএম কৃষান-এর ৬০০০ টাকা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শস্যবিমায় রাজ্যের চাষিদের যুক্ত হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি। পরিবর্তে নিজেরা বাংলা শস্যবিমা চালু করে  কৃষকদের ঠকিয়েছে। সরকারি মান্ডিতে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে একশ্রেণির মান্ডি অফিসারদের অশুভ আঁতাতের ফলে চাষি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যে ধান বিক্রি করে লাভ ঘরে নিয়ে যেতে পারেননি। রাজ্যের অসংগঠিত ক্ষেত্রে নির্ভরশীল মানুষের জীবনযন্ত্রণা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি খাতায়কলমে। বিগত নির্বাচনী ইশতেহারে তৃণমূল কংগ্রেস যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্যের আর্থিক সম্পর্কের কোনও তোয়াক্কা না করে নিজেরাই ১০০ দিনের টাকা দেবে বলে ঘোষণা করছে। আবাস যোজনায় ঘর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত কর্মসূচির বিকল্প কর্মসূচি রাজ্য সরকার আলাদা নামে চালু করেছে। এই প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ভেঙে দেয়। এতে গরিব মানুষ কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। নতুন বিনিয়োগ এনে অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে স্বপ্ন গত নিবার্চনের আগে শুনিয়েছিল তা পূরণ হয়নি কারণ শিল্পে বিনিয়োগ টানতে বছরের পর বছর রাজ্যে শিল্প সম্মেলন হয়েছে কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগ শূন্য। ফলে নতুন শিল্পের হাত ধরে উন্নয়ন বিশ বাঁও জলে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

thirteen − one =