অস্তাচলে ভারতের আর্থিক বিপ্লবের পথিকৃৎ

বিষাদ বার্তা এলো ২০২৪-এর একেবারে শেষ লগ্নে। শিক্ষাবিদ, আমলা থেকে রাজনীতিবিদ অনেক পরিচয়ই আছে প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের। কম কথা বলতেন, কাজ করতেন অন্যদের থেকে অনেক বেশি। তাঁর আমলেই বোনা হয় ভারতের আর্থিক উন্নয়নের বীজ। দেশের অর্থনীতির দশা বদলাতে দিশা বাতলে দেন তিনি।তবে ভারত তাঁকে সবথেকে বেশি মনে রাখবে ‘সংস্কারক’ হিসেবে। অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালে তাঁর স্বপ্নের বাজেট ঘুরিয়েছিল ভারতের ভাগ্য। এই স্বপ্নের বাজেটের হাত ধরেই অর্থনৈতিক ভেন্টিলেশন থেকে বেরিয়ে এসেছিল ভারত। পরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ বছরে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন তিনি। যার জন্য বিশ্ব বাজারে ভারতের জায়গা করে নেয়। চালু করেছিলেন ১০০ দিনের কাজ থেকে আধার। কেবল মুক্ত অর্থনীতি নয়, প্রকৃতই মুক্তমনা মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি এমন এক প্রধানমন্ত্রী যিনি অপরপক্ষের কথা মন দিয়ে শুনতেন, সমালোচিত হলেও কোনও ধরনের বিরূপ মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ হিসেবেই এদেশের রাজনীতিতে মনমোহনের আর্বিভাব হলেও তিনি প্রমাণ করেন আদতেই সেটা কোনও অ্যাক্সিডেন্টাল ঘটনা নয়।ভারতের অর্থনীতিকে বিশ্বের কাছে উন্মুক্ত করার স্থপতি যিনি, রেকর্ড সংখ্যক মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার কারিগর এবং জাতিকে বিশ্বব্যাপী উচ্চাসনে বসানোর মঞ্চ তো তৈরি হয় তো তাঁরই হাত ধরে। অথচ মৌনিবাবা তকমা পাওয়া এই রাজনীতিককে একসময় বলতে হয়েছিল, ‘আমার প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে আমার কোনও লজ্জা নেই।’ তবে মনমোহন সিং খুব ভাল করেই জানতেন যে তিনি রাজনীতিবিদ নন। তার কথায়, ‘একজন রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা যায়, কিন্তু সেটা হতে হলে তো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভোটে জিততে হবে।’

প্রসঙ্গত, ১৯৯১ সালে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়ে ভারত। সেই সময় বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার গিয়ে ঠেকে মাত্র ১.২ বিলিয়ন ডলারে। স্বভাবতই দেখা দেয় ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট সঙ্কট। মাথার উপর ঋণের বোঝা বাড়তেই থাকে। তখন চন্দ্রশেখরের সরকার আইএমএফ-এর থেকে ২.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় কয়েক টন সোনা বন্ধক রেখে। অবশ্য এরই মাঝে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দেশে। কংগ্রেস জয়ী হয়। প্রধানমন্ত্রী হন নরসিমহা রাও। অর্থমন্ত্রী হন মনমোহন সিং। এই সময়ে মুদ্রাস্ফীতি পৌঁছে গিয়েছিল দুই অঙ্কে। ছিল রাজস্বের বিশাল ঘাটতি। ১৯৯১ সালের ২৪ জুলাই সংসদে তার প্রথম বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং। সেই বাজেটেই  মনমোহনের হাত ধরে দেউলিয়া হওয়ার মুখে দাঁড়ানো ভারত অর্থনীতিক উদারীকরণের পথে হাঁটে। অর্থনৈতিক সঙ্কটমুক্ত করেন ভারতকে।

১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত পঞ্জাবের গাহ্-তে শিখ পরিবারে জন্ম মনমোহনের, যা বর্তমানে পাকিস্তানের অংশ। সেই সময়ে ওই গ্রামে না ছিল বিদ্যুৎ, না ছিল খাওয়ার জলের ব্যবস্থা। খুব কম বয়সেই মাকে হারান। ঠাকুমার কাছেই মানুষ মনমোহন। প্রথমে উর্দু মিডিয়াম স্কুলে শিক্ষা। গুরুমুখি, পাঞ্জাবিও জানতেন। ১৯৪৮ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন মনমোহন। এরপর ১৯৫০-এ ইন্টারমিডিয়েটে হলেন ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। প্রতিটা কড়ির হিসেব রাখা সংসারে বড় হওয়া মনমোহন পছন্দের বিষয় ছিল অর্থনীতি। ১৯৫২ সালে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হলেন মনমোহন সিংহ। এবারও তিনি প্রথম স্থানে। তারও ২ বছর পরে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর এবং যথারীতি ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, স্কুল, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় কোনও পরীক্ষায় দ্বিতীয় হননি মনমোহন। এরপরমনমোহন স্কলারশিপ নিয়ে পাড়ি দেন ইংল্যান্ডে। ১৯৫৭ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জন্স কলেজ থেকে অর্থনীতিতে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ফেরেন দেশে। পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করেন অধ্যাপনা। ১৯৬২-তে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত ন্যুফিল্ড কলেজ থেকে ডি.ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন মনমোহন সিংহ। এর মাঝে ১৯৫৮ সালে গুরশরণ কৌরের সঙ্গে বিয়ে হয় মনমোহনের। গুরশরণ আর মনমোহনের তিন মেয়ে- উপিন্দর, দামন এবং অমৃত।

এতো মেধাবী হলেও আর্থিক ভাবে মোটেই স্বচ্ছল ছিলেন না মনমোহন।তাঁর কন্যা দামন সিং বাবার সম্বন্ধে একটি লেখায় জানিয়েছিলেন কেমব্রিজে পড়াশোনা করার সময়ে অর্থ সঙ্কটে দিন কাটত মনমোহনের। পড়াশোনা আর থাকা-খাওয়ার জন্য বছরে তার ছয় শো পাউন্ড মতো খরচ হত। পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি যে বৃত্তি পেতেন তা ছিল প্রায় ১৬০ পাউন্ড। বাকি খরচের জন্য তার বাবার ওপরে নির্ভর করতে হত তাকে। এই সময় মনমোহন এতোটাই সহজ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন যে, ডিম সেদ্ধ করা বা টিভি চালাতেও পারতেন না।

এরপর ভারতে এসে অধ্যাপক হিসেবে ভারতের অত্যন্ত উচ্চমানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন মনমোহন। যে তালিকায় আছে দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিকস, জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হন। ১৯৭৬ সালে হন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থসচিব। ১৯৮০ সাল থেকে টানা দু’বছর ছিলেন যোজনা কমিশনে। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। ১৯৮২-র ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৮৫-র ১৪ জানুয়ারি অবধি তিনিই ছিলেন আরবিআইয়ের গভর্নর। ১৯৮২ থেকে ৩ বছর, আইএমএফের বোর্ড অফ গভর্নরসে, অলটারনেট গভর্নর ফর ইন্ডিয়ার দায়িত্ব সামলান মনমোহন। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৪ অবধি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৮৫-তে ইন্ডিয়ান ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হন মনমোহন সিংহ। সেই বছর ১৫ জানুয়ারি থেকে ১৯৮৭-র ৩১ জুলাই অবধি প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হন তিনি। ১৯৮৭-র ১ অগাস্ট থেকে ১৯৯০-এর ১০ নভেম্বর – এই সময়ের মধ্যে জেনেভায় সাউথ কমিশনের সেক্রেটারি জেনারেল ও কমিশনারের দায়িত্ব সামলান মনহমোহন। ১৯৯০-এর ১০ ডিসেম্বর থেকে পরের বছর ১৪ মার্চ অবধি তাঁকেই প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৯১-এর ১৫ মার্চ থেকে ৩ মাস ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশনের চেয়ারম্যান পদ অলঙ্কৃত করেন মনমোহন সিং। মনমোহন সম্পর্কে এ তথ্য বোধহয় অনেকেই জানেন না যে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আঞ্চলিক প্রধান হিসাবে কলকাতাতেও কাজ করেছেন তিনি।

এরপর ১৯৯১ সালে রাজনীতিতে প্রবেশ। দেশের প্রধানমন্ত্রীর মসনদে পিভি নরসিমহা রাও। অর্থনৈতিক-সহ একগুচ্ছ বিষয়ে দেশ তখন লড়াই করছে। অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। ঠিক এই পরিস্থিতিতে একদিন প্রায় মাঝরাতে মনমোহনকে ফোন করেছিলেন রাও-এর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি। মাঝরাতে ফোন করে জাগিয়ে বলেছিলেন, দেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নামের পাশেই পড়েছে সিলমোহর।

এরপরই জুন মাসে নতুন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও তাঁর সরকারে মনমোহনকে অর্থমন্ত্রী করেন। নরসিমহা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার পরে তার প্রথম ভাষণে তিনি ভিক্টর হুগোর বিখ্যাত উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘যদি একটি ভাবনার আসার সময় হয়ে গিয়ে থাকে, তাকে পৃথিবীর কোনও শক্তিই আটকাতে পারে না।’ স্বাধীন ভারতের অর্থনীতির ইতিহাসে এই পদক্ষেপই ছিল মোড়-ঘোরানো। ১৯৯১’এর ২১ জুন থেকে ১৯৯৬-এর ১৫ মে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালীন আমূল পরিবর্তন আসে দেশের আর্থিক নীতিতে। তাঁরই পরামর্শে শুরু হয় করের হার কমানো, ভারতীয় টাকার অবমূল্যায়ন, সরকারি সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ আর বিদেশি বিনিয়োগে উৎসাহ দেওয়ার মতো কর্মসূচিগুলি। তবে সমালোচকেরা বলে থাকেন, তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন অর্থনৈতিক সংস্কার করেছিলেন যে গতিতে, সেটা কিছুটা শ্লথ হয়ে গিয়েছিল তার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে।

এদিকে ১৯৯১-এর অক্টোবরে প্রথমবার রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন তিনি। এখানে বলে রাখা শ্রেয়, ৯৫’এর জুনে সংসদের উচ্চকক্ষে পুনর্নির্বাচিত হন মনমোহন সিং। এরপর ৯৬ থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার  আগে অবধি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের পরামর্শদাতা কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। মাঝে ১ বছর সংসদের বাণিজ্য বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বও পালন করেন মনমোহন সিং। ১৯৯৮-এর ২১ মার্চ থেকে ২০০৪-এর ২১ মে অবধি রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতাও ছিলেন তিনি-ই। ২০০১-এর জুনে তৃতীয়বারের জন্য তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য দিয়ে রাখতেই হয়, মনমোহন ভারতের সংসদের নিম্ন-কক্ষ লোকসভার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে। কিন্তু হেরে যান। এরপরে উচ্চ-কক্ষ রাজ্যসভার সংসদ সদস্য হন অসম থেকে।

এরপর আসে ২০০৪ সালের নির্বাচন। কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও  কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধি প্রধানমন্ত্রী পদ নিতে অস্বীকার করেন। সম্ভবত তিনি যেহেতু জন্মসূত্রে ইতালিয়, তাই প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হতে পারে, এটা ভেবেই সম্ভবত তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। সমালোচকরা এও বলে থাকেন যে মনমোহন সিংয়ের প্রধানমন্ত্রীত্বের সময়কালে সোনিয়া গান্ধিই ছিলেন আসল ক্ষমতার উৎস। মনমোহন সিংয়ের নিজের কোনও ক্ষমতাই ছিল না বলে মনে করেন সমালোচকরা। দেশের সমালোচকদের মন না পেলেও বিদেশের মাটিতে পেয়েছিলেন স্বীকৃতি। ২০০৫ সালে দক্ষিণ এশিয়ার কুয়ালালামপুরে আশিয়ান সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সেই সময় আশিয়ানের সেক্রেটারি জেনারেলের পদে ছিলে অং কেং অং। সিংহকে ভরা সভায় বিশ্বের সবথেকে উচ্চশিক্ষিত প্রধানমন্ত্রী বলে পরিচয় করিয়ে দেন অং। ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টারঃ দ্য মেকিং অ্যান্ড আনমেকিং অফ মনমোহন সিং ‘- বইয়ে এমনটাই উল্লেখ করেছেন লেখক সঞ্জয় বারু। এখানেই শেষ নয়। মনমোহনের কীর্তি নিয়ে রয়েছে আরও গল্পগাথা। তাঁর সিভি দেখে ঈর্ষা হতে পারে যে কোনও অর্থনীতিবিদের।

ড. মনমোহন সিংয়ের প্রথম পাঁচ বছরের মেয়াদকালে সবথেকে বড় জয় ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে পারমাণবিক প্রযুক্তি পাওয়ার জন্য একটি চুক্তি সই করা। এক সময়ে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি বৃদ্ধিতে পশ্চিমী দুনিয়ায় চক্ষুশূল হয় ভারত। ইউরোপ, আমেরিকা-সহ বিভিন্ন দেশ কোনঠাসা করতে থাকে ভারতকে। একইসঙ্গে দেশের ভেতরেও বিরোধিতার সম্মুখীন হন তিনি। ইউপিএ থেকে সমর্থন তুলে নেয় সিপিএম। আস্থাভোটে কোনওরকমে টিকে যায় সরকার। এতো কিছু প্রতিকূলতার মাঝেও প্রথমে আমেরিকার সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করেন। তবে পথ সুগম ছিল না কারণ আমেরিকা-পাকিস্তান তখন একে অপরের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। আর ভারতের শুভাকাঙ্খী রাশিয়া, মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তবু পরমাণু চুক্তি করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন যাতে ভারতকে তত্‍কালীন প্রথম বিশ্ব থেকে কোনঠাসা হতে না হয়। একদিকে রাশিয়ার বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনা, অন্য়দিকে চূড়ান্ত বাম বিরোধিতায় প্রশ্নের মুখে পরমাণু চুক্তির ভবিষ্যৎ। ‘চুপ করে থেকেই’ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করলেন মনমোহন, আলোচনা করেন। আর তাতেই সব বাধা পেরিয়ে পরমাণু চুক্তি করতে সক্ষম হয় তাঁর সরকার। এক ধাক্কায় ভূরাজনীতিতে ভারতের গুরুত্ব অনেকটা বেড়ে যায়। সেই সঙ্গে ভারতের বাজার খোলে আমেরিকার জন্য। সেই সময় এক ঝটকায় আমদানি শুল্ক ৩০০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশ করে দেন মনমোহন। কম দামে ঢোকে বিদেশি পণ্য। প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ থেকে শুরু করে এমন সব আর্থিক নীতি তৈরি করে, যাতে ভারতের বাজারের প্রতি আকৃষ্ট হয় বিদেশি কোম্পানগুলি। তবে এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলতেই হয়, ওই চুক্তির জন্য মূল্য চোকাতে হয়েছিল তাঁকে। ভারতের কমিউনিস্ট দলগুলো ওই চুক্তির বিরুদ্ধে পথে নামে এবং শেষমেশ সরকারের ওপর থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে অন্যান্য দলের কাছ থেকে সমর্থন জোগাড় করতে হয়েছিল কংগ্রেসকে। এজন্য ভোট কেনা-বেচার অভিযোগও উঠেছিল দলটির বিরুদ্ধে। তবে ভারতের প্রতিটি মানুষ ভারতের প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে এটা স্বীকার করেন যে, মনমোহনের হাতেই ভারত মুক্ত অর্থনীতি হয়ে ওঠে। যে দু’ফায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন, একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন তিনি। ২০০৭ সালে তাঁর আমলেই ভারতের জিডিপি সর্বোচ্চে গিয়ে ঠেকে। যা ছিল ৯ শতাংশ। এরপর ২০০৬-০৭ সালেই দেশের জিডিপি ছোঁয় ১০.০৮ শতাংশের মাত্রা। একইসঙ্গে পৃথিবীর দ্বিতীয় দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতি হিসেবে উঠে আসে ভারত।

শুধু তাই নয়, অন্যদিকে তিনি চিনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলার লক্ষ্যে নাথু লা দিয়ে তিব্বতের সঙ্গে ৪০ বছর ধরে বন্ধ থাকা পুরনো একটি ব্যবসায়িক রুট ফের চালুও করেন। আবার আফগানিস্তানকে বাড়তি আর্থিক সহায়তাও দিয়েছিলেন মনমোহন-ই। তিনিই ছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি আগের প্রায় তিন দশকের মধ্যে প্রথমবার আফগানিস্তান সফর করেন।

এর পাশাপাশি মনমোহনের হাত ধরে ভারতবাসী পেয়েছে ১০০ দিনের কাজ। জাতীয় গ্রামীণ রোজগার গ্যারান্টি আইন। ২০০৫ সালে মনমোহনের আনা এই আইন আজ গ্রামীণ অর্থনীতির ভিত্তি। ২০০৫ সালে মনমোহন জামানাতেই পাস হয় ঐতিহাসিক আরটিআই আইন। এই আইনের আওতায় সরকারকে প্রশ্ন করার অধিকার পায় আমজনতা। এরই পাশাপাশি ২০১৩ সালের জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের সূচনা করে মনমোহন সরকার। এই আইনে দেশের প্রায় ৮০ কোটি মানুষকে ভর্তুকিপ্রাপ্ত খাদ্যশস্য পৌঁছে দেওয়ার আওতায় আনা হয়। স্কুলের মিড ডে মিল, আইসিডিএস, পিডিএস সবকিছু খাদ্য সুরক্ষার আওতায় আসে। ২০০৭ সালে মনমোহন আমলেই দেশের অর্থনীতি ১ লক্ষ কোটি ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করে বিশ্বের তাবড় দেশের তালিকায় নাম তোলে ভারত।

এখানেই শেষ নয়, ২০০৪ সালের দেশে দারিদ্রের হার যেখানে ৩৭.২ শতাংশ ছিল। ৮ বছর পরে ২০১২ সালে তা ২১.৯ শতাংশে এসে ঠেকে। মাত্র ৮ বছরে ১৫ শতাংশের বেশি দারিদ্র কমান মনমোহন।

এরপর ২০১২ সালে মাল্টি ব্র্যান্ড রিটেলে ৫১ শতাংশ এবং সিঙ্গল ব্র্যান্ড রিটেলে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগে অনুমোদনের মাধ্যমে বাণিজ্যেও আসে এক জোয়ার।

প্রথম ইউপিএ সরকারের অন্যতম জনমোহিনী সিদ্ধান্তে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ মকুবে নতুন প্রাণ আসে কৃষিতে।

ইউপিএ সরকারের আমলে এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ছিল মিড-ডে মিলে বিনিয়োগ। প্রথমবার দেশের সব সরকারি স্কুলে চালু হয় মিড ডে মিল প্রকল্প, যেখানে ব্যাপক বিনিয়োগ করে কেন্দ্র।

শুধু তাই নয়, বাজপেয়ী আমলের সোনালি চতুর্ভুজ প্রকল্প সম্পন্ন করতে ব্যাপক বিনিয়োগ করে মনমোহন সরকার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে স্পেশ্যাল ইকনোমিক জোন গড়ে বিনিয়োগের পথ সুগম করা হয়।

আর যে আধার কার্ড আজকাল প্রায় সমস্ত সরকারি প্রকল্পে বাধ্যতামূলক, সেটা শুরু হয় মনমোহনের আমলে। ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারি ভারতীয়দের অভিন্ন পরিচয়পত্র তৈরির উদ্দশে আধার কার্ডের সূচনা হয়।

একইসঙ্গে এই মনমোহনের আমলেই মহাকাশ গবেষণা নতুন দিশা পায়। ২০০৮ সালে দেশের প্রথম চন্দ্রযানের উৎক্ষেপণ। ২০১৩ সালে মঙ্গলযানের উৎক্ষেপণও হয় মনমোহনের আমলেই।

মনমোহনের আমলে আরও এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ পোলিওমুক্ত ভারত গড়া। এরপর ২০১২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ভারতকে পোলিওমুক্ত ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

আর দুর্বল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিহিত মনমোহনই দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ সরকারকে শুদ্ধ করতে ২০১৩ সালে আনেন লোকপাল আইন। এই আইনে ক্ষমতাসীন নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য জনলোকপাল প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এই মনমোহন সিংকেই ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের প্রাক্কালে বলতে শোনা যায় তিনি আর প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য দাঁড়াবেন না। ওই বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে শেষ বারের মতো সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ‘মৌনী প্রধানমন্ত্রী’ মনমোহন। প্রধানমন্ত্রী পদে থাকাকালীন বহুবার বিরোধীদের কটাক্ষের মুখে পড়তে হয়েছে। তাঁর বহু সিদ্ধান্তের সমালোচনা করতে পিছপা হননি বিরোধী নেতারা। সেই সব কটাক্ষের পাল্টাও দিয়েছিলেন শেষ সাংবাদিক বৈঠকে। সেদিন তিনি এও বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি না যে আমি দুর্বল প্রধানমন্ত্রী। আশা করি, বিরোধী এবং সংবাদমাধ্যমের চেয়ে ইতিহাস আমার প্রতি সদয় থাকবে বেশি। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব ছিল করেছি।’ এর পাশাপাশি তাঁর সংযোজন ছিল,’পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে যা যা করা দরকার ছিল আমি করেছি। ইতিহাস আমার কাজের বিচার করবে।’

মনমোহন সিংকে অবশ্য জোট সরকার চালাতে বারেবারেই বেশ বেগ পেতে হয়েছে। বিশেষ করে রাজ্যভিত্তিক জোট-সঙ্গী দল এবং তাদের সমর্থকদের উচ্ছৃঙ্খল কার্যকলাপ বারবার বিব্রত করেছে মনমোহন সিং এবং তাঁর সরকারকে। তিনি অবশ্য সবসময়েই ঐকমত্যের ভিত্তিতেই চলার চেষ্টা করেছেন। বেআইনিভাবে কয়লা খনির বরাত দেওয়া নিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা অর্থমূল্যের কয়লা কেলেঙ্কারি নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তাঁকে নিশ্চুপ থাকতেই দেখা যায়। এই নীরবতা প্রসঙ্গে তাঁর যুক্তি ছিল, এভাবে যে চুপ করে থাকাটা ‘হাজার শব্দ দিয়ে জবাব দেওয়ার থেকে ভাল’। আবার ২০১৫ সালে যখন আদালত তাকে ডেকে পাঠায় ফৌজদারি ষড়যন্ত্র এবং দুর্নীতির অভিযোগে, দৃশ্যতই মনোক্ষুন্ন মনমোহন সিং সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে তিনি ‘আইনি বিচারের জন্য প্রস্তুত’ আর ‘সত্যের জয় হবে।’ তবে মনমোহনের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ সবসময়েই থেকেছে, তিনি ছিলেন খুব নরম প্রকৃতির মানুষ আর ভুগতেন সিদ্ধান্তহীনতায়। এমনকী বিজেপির নেতা ও ভারতের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানিও একবার মনমোহন সিংকে দেশের ‘দুর্বলতম প্রধানমন্ত্রী’ হিসাবে অভিহিত করেছিলেন। তবে তাঁর সততা বা বুদ্ধিমত্তা ছিল সন্দেহাতীত। আজ তাঁর মৃত্যুতে মুছে গিয়েছে সব রাজনৈতিক ভেদাভেদ। সকলে এককথায় স্বীকার করছেন তিনিই ছিলেন ভারতের আর্থিক বিপ্লবের পথিকৃৎ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

17 − six =