কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে হাইকোর্টের রায়ই বহাল শীর্ষ আদালতে

‘নির্বাচন করানো মানে হিংসার লাইসেন্স দেওয়া নয়। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনও গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য। হিংসার পরিবেশে নির্বাচন করা যাবে না।‘ ঠিক এই ভাষাতেই সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার মুখেই পড়তে হল রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে। পঞ্চায়েত ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয় পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচন কমিশন এবং রাজ্য সরকার। তবে তাতে কাজের কাজ কিছু হল না। মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টের রায়ই বহাল রাখল সুপ্রিম কোর্ট। পাশাপাশি শীর্ষ আদালতের তরফ থেকে স্পষ্ট জানিয়েও দেওয়া হয়, এই রায়ে কোনও হস্তক্ষেপ করা হবে না তাঁদের তরফ থেকে। অর্থাৎ, পঞ্চায়েত ভোট হবে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েই। একইসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের তরফে বিচারপতি বিবি নাগরত্ন এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রর বেঞ্চের তরফ থেকে এদিন রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে স্পষ্টভাবে জানানো হয়, পঞ্চায়েত ভোট সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণভাবে করানোর দায় তাদেরই।

প্রসঙ্গত, পঞ্চায়েত নির্বাচনকে নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে শনিবার সুপ্রিম কোর্টে স্পেশ্যাল লিভ পিটিশন দাখিল করে রাজ্য ও রাজ্যের কমিশন। সোমবার রাজ্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সওয়াল করেন আইনজীবী মীনাক্ষী আরোরা। তিনি সওয়াল করার সময় জানিয়েছিলেন, হাইকোর্ট ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বুথওয়াড়ি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু বাহিনী চাওয়া কমিশনের কাজ নয়। এরপর মঙ্গলবার সকালে শুনানির শুরু থেকেই কার্যত শীর্ষ আদালতের চাপের মুখে পড়ে কমিশন ও রাজ্য। কমিশনকে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকেন বিচারপতি নাগারত্ন। তার উত্তর দিতে রীতিমতো বেগ পেতে হয় কমিশনকে।

আদালত সূত্রে খবর, এদিনের সওয়াল জবাবের শুরুতে রাজ্য ও কমিশনের তরফ থেকে প্রস্তুতির খতিয়ান, মুখ্যসচিবকে দেওয়া চিঠি, অ্যাসেসমেন্টের চিঠি নথি হিসাবে দেওয়া হয়। কিন্তু তারপরই মামলাকারীদের আইনজীবীরা একটার পর একটা প্রমাণ দেওয়া শুরু করেন। ১৪ ও ১৬ জুন পর্যন্ত হিংসার ঘটনার বিবরণ ও হাইকোর্টে দেওয়া কমিশনের নথি পেশ করেন। কিন্তু তার প্রেক্ষিতে রিপোর্ট’ পেশ করতে পারেনি কমিশন। কমিশনের তরফ থেকে সেই রিপোর্ট তৈরিই করা হয়নি। তবে এদিনের শুনানিতে কমিশনের তরফে থেকে দুটি বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়। কমিশনের বক্তব্য, বাহিনী চাওয়ার এক্তিয়ার তাদের নেই। রাজ্য ও কমিশনের আইনজীবী একযোগে বলেন, অতীত ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে রাজ্যের বেশি কিছু বুথকে স্পর্শকাতর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। আর সেই প্রক্রিয়াও সম্পূর্ণ। এরই রেশ ধরে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য, হাইকোর্ট এই রিপোর্টের ওপর ভরসা না রেখে কার্যত গোটা রাজ্যকেই স্পর্শকাতর হিসাবে গণ্য করার নির্দেশ দিয়েছে। হাইকোর্টের রায়ের শেষ অংশ বলা হয়েছে, প্রত্যেক জেলাতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে। এখানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির বেশ কয়েকটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন। বিচারপতি নাগারত্ন এরই প্রেক্ষিতে রাজ্য ও কমিশনের কাছে জানতে চান, যখন বাংলার পরিস্থিতি সামলাতে অতিরিক্ত বাহিনীর প্রয়োজন রয়েছে বুঝতে পেরে, পাঁচ রাজ্য থেকে বাহিনী চাওয়া হয়, তাহলে সেই বাহিনী অন্য কোনও রাজ্য থেকে যদি না এসে কেন্দ্র থেকে আসে, তাহলে রাজ্যের আপত্তি কোথায় তা নিয়ে। অতিরিক্ত বাহিনী প্রয়োজন সেটা স্পষ্ট আর তা যদি কেন্দ্রের হয় সেখানে কী অসুবিধা রয়েছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের বা রাজ্যের তাও জানতে চান তিনি। এরই রেশ ধরে বিচারপতি বিভি নাগরত্ন এ প্রশ্নও করেন, ‘আপনারা পুলিশ চেয়েছেন আর কলকাতা হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে বলেছে। আপনাদের সমস্যা কোথায়? খরচ তো কেন্দ্র দেবে।‘

উত্তরে রাজ্য নির্বাচন কমিশন জানায়, ‘রাজ্যের পুলিশ যথেষ্ট সমর্থ। পুলিশ কর্মী কম থাকায় পাঁচ রাজ্যের থেকে পুলিশ চাওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যেই সমস্ত পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার অর্থ পরিকল্পনা বদলে ফেলা। যা নিয়ে সমস্যা তৈরি হতে পারে।‘ এরই পাশাপাশি রাজ্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী এও জানান, ১৩ জুন প্রথমে পাঁচ জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার রায় দেয় কলকাতা হাইকোর্ট। এরপর ১৫ জুন ফের রায় বদল করে সব জেলায় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের কথা বলা হয়।‘ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কেন সিদ্ধান্ত বদল তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

এরপরই বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনে বর্তমান পরিস্থিতি ও অভিযোগের প্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালতের বিচারপতি নাগারত্ন এও বলেন, হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে ২০১৩, ২০১৮ হিংসার একটি পুরানো ইতিহাস রয়েছে। হিংসার পরিবেশে নির্বাচন হতে পারে না। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হতে হবে। এরই রেশ ধরে বিচারপতি নাগারত্ন এ প্রশ্নও করেন, কমিশন যেগুলোকে স্পর্শকাতর হিসাবে চিহ্নিত করেছে, সেগুলিকে বাদ দিয়ে যদি বাকিগুলোতেও কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট করানো হয়, তাহলে আপত্তি কোথায় তা নিয়েও।

সঙ্গে বিচারপতি নাগারত্ন এও বলেন, মনোনয়নপত্র দাখিলের স্বাধীনতা নেই এমন লোকদের যদি হত্যা করা হয়, তাহলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নই ওঠে না। এই ধরনের হিংসার ঘটনা পরিপ্রেক্ষিতে, অন্তত হাইকোর্টও তেমনই নির্দেশ দিয়েছে। এরপর কার্যত নিশ্চুপ থাকে রাজ্য ও কমিশন।

কারণ, মামলাকারীরা মূলত একটি বিষয়ের ওপরেই জোর দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, ১৬ জুন অর্থাৎ যখন নির্বাচনী প্রক্রিয়া তুঙ্গে, রাজ্যের একাধিক প্রান্ত থেকে অশান্তির খবর আসছে, হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দিচ্ছে, তখন কমিশনের কাছে কোনও বিস্তারিত প্ল্যানিং নেই। কীভাবে পরিস্থিতি সামলাবে, তার কোনও পরিকল্পনাই ছিল না।

শুনানি শেষে হাইকোর্টের রায়ের বিরোধিতা করেননি বিচারপতি। সব পক্ষের সওয়াল জবাব শোনার পর শেষ পর্যন্ত বিচারপতি জানান, ১৫ জুন হাইকোর্ট যে নির্দেশ দিয়েছিল, অর্থাৎ বাংলায় অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে হবে, সেই নির্দেশই বহাল থাকবে। হাইকোর্টের নির্দেশে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করবে না বলেও জানিয়ে দেন বিচারপতি নাগারত্ন।

প্রসঙ্গত, বাংলা পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণার পর থেকেই অশান্ত রাজ্যের একাধিক জেলা। রাজনৈতিক দলের কর্মীরা একে অপরের সঙ্গে মারধর, হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। হয়েছে  ব্যাপক বোমাবাজি, চলেছে গুলি। খড়গ্রাম, চোপড়া, ভাঙড়ে একের পর এক মৃত্যুর খবর মেলে। এই পরিস্থিতি অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের লক্ষ্যে রাজ্যে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের রায় দেয় কলকাতা হাইকোর্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

three + thirteen =

preload imagepreload image