অসম্ভব রকম কমেছে কলকাতায় গাছের সংখ্যা। অথচ কলকাতা পুরভা বা নানা বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে কলকাতাতে প্রায়ই দেখা যায় বৃক্ষরোপণ উৎসবের ঘনঘটা। তবে এতো কিছুর পরও গাছ নিয়ে মোটেই ভাল পরিসংখ্যান মিলছে না কলকাতার একটা বিস্তীর্ণ অংশে। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, মেট্রো শহরে ব্যক্তি-পিছু ৯.৫ বর্গমিটার সবুজ-আচ্ছাদন বা অন্তত ৩-৫টি গাছ থাকা জরুরি। এদিকে কলকাতায় সবুজের পরিমাণ কেমন তা নিয়ে সমীক্ষা চালানোর পর জানা যায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যা বলছে তার তুলনায় অনেক কম গাছ রয়েছে কলকাতার একটা বিরাট অংশে। শুধু ‘হু’-ই নয়, পাশাপাশি ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স- এর সমীক্ষা বলছে, মানুষ ও গাছের সংখ্যার সর্বনিম্ন অনুপাত হওয়া উচিত সাতজন পিছু একটি গাছ এই অনুপাতে। এদিকে কলকাতায় প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ২৪ হাজার জন অধিবাসী ধরে শুধু কলকাতা মিউনিসিপ্যাল এলাকায় জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১ কোটি ৫১ লক্ষ ৩৪ হাজার। তাহলে সরল পাটিগণিতের হিসেবে গাছের সংখ্যা হতে হয় ১০ কোটির কিছু বেশি।
বছর খানেক আগে কেন্দ্রীয় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রকের সমীক্ষাতেও উঠে এসেছিল, কলকাতায় ২০১১ থেকে ২০২১, এই দশ বছরে সবুজ কমেছে ৩০ শতাংশ। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১১-য় শহরে সবুজ-আচ্ছাদন ছিল ২.৫ বর্গ কিলোমিটার। যা এখন এসে ঠেকেছে ১.৭৭ বর্গ কিলোমিটারে।
আর এখানেই হতাশ শহরের পরিবেশপ্রেমীরা। কারণ, সমীক্ষায় জানা গেছে, কলকাতা শহর আর শহরতলির মোট গাছের সংখ্যা মাত্র ৫ লক্ষ। সেই সঙ্গেই পরিবেশকর্মীরা দুষছেন অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং তথাকথিত উন্নয়ন প্রকল্পে অবাধ বৃক্ষ-নিধনকেও। সবুজের ক্রম-হ্রাসমানতার জেরেই শহরে বৃষ্টিপাত কমছে এবং তাপমাত্রা বাড়ছে বলে মত পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের। তাঁদের বক্তব্য, ‘শুধু বৃষ্টিপাত কমা বা তাপমাত্রা বাড়াই নয়, আর্দ্রতার পরিমাণও বছর-বছর বাড়ছে। গাছের সংখ্যা কমার কারণেই তৈরি হয়েছে এমনই এক পরিস্থিতি।’ সঙ্গে তাঁরা এও জানান, এর জন্য দরকার দ্রুত শহরে গাছের সংখ্যা বৃদ্ধি। তার জন্য মাটির চরিত্র বিশ্লেষণ করে গাছ পুঁততে হবে। সঙ্গে জোর দিতে হবে তাকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় তার ওপর।
এই প্রসঙ্গে পরিবেশ প্রযুক্তিবিদদের মত,’ঝড়ে গাছ পড়ে যাচ্ছে কিন্তু সেই স্থানটিও পূরণ হচ্ছেনা। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে একটি গাছ পড়ে গেলে তার জায়গায় দশটি চারা রোপণ করতে হবে,যদি তাতে কিছুটা সামাল দেওয়া যায়। ‘ কারণ সমীক্ষা বলছে, কলকাতায় মানুষ ও গাছের সংখ্যার অনুপাত ভারতের অন্যান্য শহরের তুলনায় সবথেকে পিছিয়ে কলকাতা। এদিকে এই সমস্যা নিয়ে পথে নামে ‘স্ট্যান্ড ফর গ্রিন কলকাতা’-ও। এই সংগঠনের বক্তব্য, অনাবশ্যক কংক্রিট ঢালাইয়ের কারণে কলকাতার গাছের সংখ্যা দ্রুতহারে কমেছে। পার্ক গুলির উন্মুক্ত স্থান গুলিও কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তার পাশে নর্দমা বাঁধাইয়ের কারণেও অনেক গাছ না বাঁচিয়ে কেটে ফেলা হয়েছে। এই বিষয়ে এখন কেউ মাথাও ঘামাচ্ছে না। এদিকে সবুজ কমায় শহরে বাড়ছে ফুসফুসের নানা রোগ। সঙ্গে উদ্বেগজনক ভাবে বাড়ছে ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যাও।
এই পরিস্থিতিতে শহরে সবুজের সংখ্যা বাড়াতে ফাঁকা জায়গা চিহ্নিত করে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নেয় পুর-কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই ফাঁকা জায়গা নিয়েও বিস্তর সমস্যা। এই প্রসঙ্গে, মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমারের বক্তব্য, ‘যেখানে-যেখানে সবুজ কম সেখানে গাছের সংখ্যা বাড়ানোই লক্ষ্য। সে কারণেই সমীক্ষার সিদ্ধান্ত।’ এদিকে কলকাতায় সবুজ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে পুরসভার উদ্যান বিভাগের কর্তাদের ব্যাখ্যা, আমফানে এবং যশের দাপটে ৬ ফুটের বেশি উচ্চতার গাছ পড়েছে ১৫ হাজার। সেই সঙ্গে মেট্রো প্রকল্পেও অনেক গাছ কাটা পড়েছে। তা ছাড়া কংক্রিটের পরিমাণ এত বেশি যে গাছ লাগানোর জায়গারও অভাব। তার জেরে কমছে সবুজ। মেয়র পারিষদ (পরিবেশ) স্বপন সমাদ্দারের আক্ষেপ, ‘অন্য শহরের তুলনায় ফাঁকা জায়গা কম কলকাতায়। তবুও আমরা জায়গা খুঁজে গাছ লাগাচ্ছি। ফ্লাইওভারের পিলারে গাছ লাগানো, বড় আবাসনে সবুজের সংখ্যা বাড়ানোতেও জোর দেওয়া হচ্ছে।’
এখন সবথেকে বড় প্রশ্ন আমরা কতদিন আর এই ব্যাপারে উদাসীন থাকব। যদি ধরে নেওয়া যায়, কলকাতায় সমস্ত যানবাহন স্তব্ধ করে দেওয়া হল,সমস্ত ধুলোবালি ঢেকে দেওয়া হল তবুও মানুষের নিঃশ্বাসের সঙ্গে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইডের শোষণ করার জন্য যত সংখ্যায় গাছ দরকার, সেটাই বা কোথায়’?