সোমবার সকাল ৮টা বাজতেই পানিঘাটা হাইস্কুলে শুরু হয়ে যায় কালীগঞ্জ উপনির্বাচনের ভোট গণনা। ২০২১ সালে কালীগঞ্জ কেন্দ্রে ৪৭ হাজারের বেশি ভোটে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপি প্রার্থীকে পরাজিত করেছিলেন তৃণমূলের নাসিরউদ্দিন আহমেদ। তাঁর অকাল প্রয়াণেই উপনির্বাচন হয়েছে গত ১৯ জুন। বৃহস্পতিবারের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৬৯ শতাংশ।
এদিনের এই ফল ঘোষণার শুরু থেকেই এগিয়ে ছিলেন তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমেদ। তবে দ্বিতীয় স্থান আর তৃতীয় স্থান নিয়ে সপ্তম রাউন্ড পর্যন্ত চলে জোর টক্কর। কখনও দ্বিতীয়ে উঠে আসেন বাম–কংগ্রেস প্রার্থী কাবিলউদ্দিন শেখ, আবার কখনও বা বিজেপির আশিস ঘোষ। এরপর বিজেপি প্রার্থীর থেকে ক্রমশই বাড়তে থাকে ব্যবধান।
উপনির্বাচনে ২৩ রাউন্ড গণনা শেষে জানানো হয় চূড়ান্ত ফলাফল। নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়, ৪৯,৭৫৫ ভোটে জয়ী তৃণমূল প্রার্থী আলিফা আহমেদ। বিরোধী দল হিসেবে দ্বিতীয় স্থানে বিজেপি, তৃতীয়ে কংগ্রেস। বিজেপির পক্ষে ভোট পড়েছে ৫২৪২৪। আর কংগ্রেসের পক্ষে ২৮২৬২। নোটায় পড়ে ২৫০০ ভোট।
এইপ্রসঙ্গেবলেরাখাশ্রেয়, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীর পিতা, কালীগঞ্জের প্রয়াত তৃণমূল বিধায়ক নাসিরুদ্দিন (লাল) আহমেদ ৪৬,৯৮৭ভোটেজয়ীহয়েছিলেন।পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখতে গেলে এই নির্বাচনের চার বছর পরে বাবা নাসিরুদ্দিনকেও ছাপিয়ে গেলেন কন্যা আলিফা।
কালীগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনে দলের সাফল্যের জন্য সাধারণ মানুষ এবং দলীয় কর্মীদের ধন্যবাদ ও প্রণাম জানালেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সোমবার সমাজমাধ্যমে একটি পোস্ট করে মুখ্যমন্ত্রী লেখেন, ‘কালীগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে এলাকার সব ধর্ম, সব বর্ণ, সব জাতি এবং সর্বস্তরের মানুষ তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে আমাদের বিপুল ভাবে আশীর্বাদ করেছেন। আমি নতমস্তকে তাঁদের আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এই জয়ের প্রধান কারিগর মা–মাটি–মানুষ।’ এরই পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী এও লেখেন, ‘আমার কালীগঞ্জের সহকর্মীরা এর জন্য প্রাণপাত পরিশ্রম করেছেন। তাঁদেরও আমি আমার আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। সবার জন্য রইল আমার প্রণাম ও সালাম। প্রয়াত বিধায়ক নাসিরুদ্দিন আহমেদকে স্মরণ করে আমি এই জয় বাংলার মা–মাটি–মানুষকে উৎসর্গ করছি।’
কালীগঞ্জ নির্বাচনে জয়ের পরই তৃণমূল প্রার্থী জানান, ‘মানুষকে ধন্যবাদ। মানুষ উন্নয়নের পক্ষে ভোট দিয়েছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি কালীগঞ্জের মানুষ ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। বাংলাতেও এই রাজনীতির কোনও ঠাঁই নেই।’ একইসঙ্গে তিনি এও জানান, সব ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায়ের ভোট তাঁর পক্ষে পড়েছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের চোখে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই উপনির্বাচন কার্যত অ্যাসিড টেস্ট ছিল শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস ও প্রধান বিরোধী বিজেপির কাছে। সেই প্রেক্ষিতে তৃণমূলের জন্য সুখবরের ইঙ্গিত। তবে এই ফলে মোটেই হতাশ নন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি জানান, ‘কালীগঞ্জে উপনির্বাচনে ভোট দিতে দেয় না। আমাদের আসন হলেও জোর করে তৃণমূল নিয়ে নেয়। কালীগঞ্জে হিন্দু বুথে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ ভোট পদ্মফুলে লোক দেবে।’
এদিকে এদিন ফল প্রকাশের পর বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী কাবিলউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘বিজেপি এবং তৃণমূল মেরুকরণের রাজনীতি করেছে। তবে তিনি ধর্মনির্বিশেষে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ভোট পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন । প্রসঙ্গত, গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের প্রার্থী আবুল কাশেম পেয়েছিলেন ২৫,০৭৬ ভোট। উপনির্বাচনে বাম সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন ২৮,২৬২টিভোট।
এদিকে এদিন উপনির্বাচনের ফলপ্রকাশে প্রতিটি রাউন্ডে এগিয়ে খবর আসতে থাকে শাসকদল তৃণমূলের, ঠিক তখনই দলীয় প্রার্থীর জয়ের উল্লাসে দুপুর থেকে বোমাবাজি শুরু হয় নদিয়ার কালীগঞ্জের মোলান্দিতে। আর এই বোমাবাজির জেরে মৃত্যুও হয় তামান্না খাতুন নামে এক শিশুর। বাড়ি ফেরার পথে বোমার আঘাতে তার মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ। একইসঙ্গে এও জানা গিয়েছে ওই শিশুকন্যা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত। এদিকে স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, অভিযোগ, তৃণমূলের বিজয়োল্লাস থেকেই এই বোমা ছোড়া হয়।
আর এই ঘটনায় জয়ের মাঝেও কোথাও এক বিষাদের সুর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। তিনি তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে বোমাবাজিতে ওই শিশু কন্যার মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করার পাশাপাশি পুলিশ প্রশাসনকে কড়া নির্দেশ দেন দ্রুত দোষীদের চিহ্নিত করে কড়া শাস্তি দেওয়ার। এক্স হ্যান্ডেলে ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্টতই লেখেন, ‘কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার অন্তর্গত বারোচাঁদগড় এলাকায় বোমা বিস্ফোরণে এক নাবালিকার মৃত্যু হয়েছে। আমি স্তম্ভিত, অত্যন্ত ব্যথিত। তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। পুলিশ অবশ্যই এ বিষয়ে দ্রুত কড়া আইনি পদক্ষেপ নেবে। দোষীদের যত দ্রুত সম্ভব কড়া শাস্তি দিতে হবে।’ সোমবারের কালীগঞ্জের এই ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশনও। সূত্রে খবর, এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের কাছে রিপোর্টও তলব করা হয়।
এদিকে সূত্রে খবর, সোমবার দুপুর নাগাদ মোলান্দির এক সিপিএম সমর্থকের বাড়ি লক্ষ্য করে শুরু হয় বোমাবাজি। আর এই বোমাবাজিতে গুরুতর জখম হয় চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রী। এই ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই মৃত্যুও হয় তার। খুব স্বাভাবিক ভাবেই নিজের দলের জযের খবরের সঙ্গে এই খবরও পৌঁছয় মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। এরপর নিজের প্রতিক্রিয়া দিতে এক মুহূর্ত দেরি করেননি তিনি। এদিকে রাজ্য পুলিশের তরফ থেকেও সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করে জানানো হয়, এমন ঘটনার জন্য যারা দায়ী, কোনও ভাবেই ছাড় পাবে না।তাদের ধরতে জোরদার তল্লাশি চলছে।