যিনি কোনওদিন বক্স অফিসের কথা ভেবে ছবি করেননি। আপোস করেননি তাঁর বোধ বা শিল্পীসত্তার সঙ্গে। যাঁর পাণ্ডিত্য ও মার্জিত রুচির ছাপ থাকত তাঁর সৃষ্টিতে। বলিউডি ঘরানার পরিচালক না হলেও বলিউডের সমস্ত পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও কলাকুশলীদের কাছে যিনি ছিলেন অত্যন্ত সম্মানীয়, তিনিই কুমার সাহানি।
কুমার সাহানির জন্ম ১৯৪০ সালে অবিভক্ত ভারতের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায়, বর্তমানে যেটা পাকিস্তানে রয়েছে। দেশভাগের সময় তিনি মুম্বই চলে আসেন। স্নাতক হন বোম্বের বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। পরে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে সিনেমা নিয়েই পড়াশোনা তাঁর। সেখানে পড়ার সময় ঋত্বিক ঘটকের ছাত্র ছিলেন তিনি। পরে তিনি ফ্রান্সে পড়াশোনার জন্য ফরাসি সরকারের বৃত্তি লাভ করেন। এরপর সেখানেই করেন সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা। ১৯৬৯ সালে বিখ্যাত ফরাসি পরিচালক রবার্ট ব্রেসনের ‘অ্যা জেন্টাল ক্রিয়েটার’ ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজও করেছিলেন। পরিচালক প্যাসোলিনি এবং আন্দ্রেই তারকভস্কির কাজে অনুপ্রাণিতও হন কুমার সাহানি। তবে কুমার সাহানি আজীবন ঋত্বিক ঘটককেই তাঁর প্রথম ও প্রধান গুরু বলে মানেন। ঋত্বিক ছবির অর্থবিন্যাসের সঙ্গে রিচুয়ালের মিল নিয়ে সাহানি বলেছিলেন, প্রাথমিক স্তরে একটা টানা গল্প হয়তো থাকে। একটু গভীর স্তরে প্রবেশ করলে দেখা যায় রাজনৈতিক সামাজিক দ্যোতনা। আরও গভীরে প্রবেশ করে যার মন সে দর্শনগত সংকেত খুঁজে পায়। আর তারপরের স্তরে যে যায় সে ‘অজ্ঞেয় কিছু একটার দোরগোড়ায় গিয়ে উপস্থিত’ হয়। এক বিখ্যাত লেখায় কুমার বলেছিলেন, ঋত্বিকের উত্তরাধিকার বহন করবার অর্থ তাঁর মতো করে ছবি করা নয়, বরং সব ঐতিহ্যের মতোই সেই উত্তরাধিকারকে ভেঙে-চুরে নেওয়া।
ষাটের দশকে মূলত স্বল্প দৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্রের মাধ্যমে পরিচালনায় হাতেখড়ি হয় সাহানির। ১৯৭২ সালে মুক্তি পায় হিন্দি ঔপন্যাসিক নির্মল বর্মার কাহিনি অবলম্বনে তাঁর পরিচালিত প্রথম কাহিনিচিত্র ‘মায়া দর্পণ’। এটি সে বছর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পায়। শুধু তাই নয়, এর দুই বছর পর চলচ্চিত্রটি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০২২ সালে, ‘মায়া দর্পণ’ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি যা করতে চেয়েছিলাম তা হল যেভাবে আমাদের ঐতিহ্যগুলি জনপ্রিয় শিল্পে টিকে আছে তা বিবেচনা করা। মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা এই শিল্পের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি তার পরিবেশনাও সাহিত্য ও একটি মহাকাব্যের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।’ এরপরেও দ্বিতীয় ছবি পরিচালনার জন্য সাহনিকে অপেক্ষা করতে হয় ১২ বছর। শোনা যায়, তাঁর ছবির জন্য তিনি প্রযোজক পাননি। ১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ও সাহনি পরিচালিত ‘তরঙ্গ’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ওম পুরী, স্মিতা পাটিল, গিরিশ কারনাড ও অমল পালেকর। ‘তরঙ্গ’ এক ব্যবসায়ী পরিবারের ভিতরকার সংঘাতের নাটক। তাতে ষড়যন্ত্র, যৌনতা, অপরাধ সবরকমের উপাদানই রয়েছে। অন্যদিকে আবার সাত ও আটের দশকের ভারতে পুঁজি-শ্রম দ্বন্দ্বের খতিয়ান রয়েছে। এসবের পিছনে পিছনে চলেছে এক ‘চিরকালীন’ কাহিনি– নারীসত্তার ব্যাপ্তি ও ট্র্যাজেডি। শেষ দৃশ্যে যখন ভোরের আধো আলোয় জানকী (স্মিতা পাটিল) আর রাহুল ( অমল পালেকর) সেতুর উপরে দুই পৌরাণিক চরিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, কাব্যের ভাষায় কথা বলে, তখন বোঝা যায় আরও প্রাচীন কোনও আখ্যান এতক্ষণ অন্তঃসলিলার মতো বয়ে চলেছিল। এই প্রসঙ্গে বলতেই হয়,অনেকেই মনে করেন ‘তরঙ্গ’-র জানকীর মধ্যে ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র (১৯৬০) নীতার ছায়া রয়েছে। এরপর ১৯৯৭-এ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘চার অধ্যায়’ পরিচালনা করেন। যেখানে ১৯৩০ এবং ১৯৪০ এর দশকের বাঙালি রেনেসাঁর সময় একদল তরুণ বুদ্ধিজীবী এবং বিপ্লবীদের চিত্রিত করে। আর ‘কসবা’ (১৯৯০) তৈরি হয়েছিল রাশিয়ান লেখক আন্তন চেকভের উপন্যাস ‘ইন দ্য গাল্লি টু হিমাচল প্রদেশ’র অনুপ্রেরণায়। সিনেমাতে কাংড়া চিত্রকলার ঐতিহ্য ব্যবহার করা হয়েছে। ‘খেয়াল গাথা’ সিনেমাটি হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে খেয়াল গানের বিবর্তনের একটি কাল্পনিক উপস্থাপনা। আর ‘ভাবন্তরানা’ (১৯৯১) ওড়িশি নৃত্যের আংশিকভাবে একটি কল্পকাহিনী তথ্যচিত্র।
এই প্রসঙ্গে আরও একটা কথা না বললেই নয়, কুমার শুধু গল্পের যুক্তি মেনে সম্পাদনা করতেন না, রঙের সূত্র ধরেও শটের সঙ্গে শটের সংযোগ খুঁজতেন। মনোযোগী দর্শক রঙের বিন্যাস চিনতে পারে, কিন্তু এইভাবে রঙের সংযোগ-সূত্র ধরে ছবির সঙ্গে এগোনোর অভ্যাস আমাদের কারোরই বিশেষ নেই। আর রঙের চরিত্র নিয়ে কুমার যা করবার চেষ্টা করেছেন তা ভারতীয় ফিল্মি জগতে এক পৃথক দিক নির্দেশ করে। তাঁর ‘মায়া দর্পণ’, ‘খেয়াল গাথা’, ‘কসবা’-র জন্য ৩ বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে সম্মানিত হন কুমার সাহানি। তার পরবর্তী উদ্যোগ ছিল ‘দ্য ব্যাম্বু ফ্লুউট’। কুমারের সর্বশেষ কাজ হল ২০০৪ সালে ‘অ্য়াজ দ্য় ক্রো ফ্লাইজ’। কুমার সাহানির ফিল্মগ্রাফির মধ্যে রয়েছে আরও বেশ কয়েকটি ফিল্ম। ‘দ্য গ্লাস প্যান’ (ডিপ্লোমা ফিল্ম, ১৯৬৫) , ‘মনমাদ প্যাসেঞ্জার’ (শর্ট ফিল্ম, ১৯৬৭), ‘একটি নির্দিষ্ট শৈশব’ (শর্ট ফিল্ম, ১৯৬৯), ‘রেলস ফর দ্য ওয়ার্ল্ড’ (শর্ট ফিল্ম, ১৯৭০), ‘অবজেক্ট’ (শর্ট ফিল্ম, ১৯৭১), ‘পেটে আগুন’ (শর্ট ফিল্ম, ১৯৭৩), ‘আওয়ার ইউনিভার্স’ (শর্ট ফিল্ম, ১৯৭৬), ‘ভার ভার ভারি’ (শর্ট ফিল্ম, ১৯৮৭), ‘এ শিপ আগ্রাউন্ড’ (শর্ট ফিল্ম, ১৯৮৯)।
কেবল নির্দেশক নন, কুমার সাহানি এক উচ্চপ্রশংসিত সাহিত্যিকও। তাঁর ‘দ্য শক অফ ডিজায়ার অ্যান্ড এসেস’-এর মতো কাজগুলি থেকে যাবে। ভারতে নবতরঙ্গ বা সমান্তরাল ছবির অন্যতম পথিকৃত চলে যাওয়ায় রিক্ত হল ভারতীয় সিনেমা। তবে তাঁর কাজ অনুপ্রাণিত করবে আরও একাধিক প্রজন্মের পরিচালকদের।