পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে প্রশ্ন উঠেছে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে। কারণ, নির্বাচনের মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে রক্ত ঝরেছে বাংলায়। গেছে প্রাণ। শাসক বিরোধীদের মনোয়ন জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে উঠেছে বিস্তর অভিযোগ। তবে তাতে কোনও সদর্থক পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে। এমনকী আদলত থেকে বিরোধী প্রার্থীদের পুলিশি ঘেরাটোপে নিয়ে গিয়ে মনোনয়ন জমার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সে নির্দেশও মানা হয়নি। এরপর আদালতের সঙ্গে কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়েও তরজায় জড়িয়েছে নির্বাচন কমিশন। ফলে সব মিলিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনে কমিশনার হিসেবে সদ্য নিযুক্ত রাজীব সিনহাকে ভর্ৎসনার মুখে পড়তে হয় আদালতে। এরই মধ্যে আবার সেই কমিশনারের জয়েনিং রিপোর্ট ফেরত পাঠিয়েছেন রাজ্যপাল। সব মিলিয়ে এক নজিরবিহীন পরিস্থিতি রাজ্যে। এদিকে আদালতে শুনানি চলাকালীন উঠে এসেছে ২০১৩-র নির্বাচনের প্রসঙ্গ। সেই সময় কত বেশি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল, সেই প্রসঙ্গ তুলেছেন হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। ২০১৩-তে সেই ভোটের সময় কমিশন-রাজ্যের সংঘাত বাধে। সেই সময় মীরা পাণ্ডে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার আর্জি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গিয়েছিলেন। প্রাক্তন কমিশনার জানান, সে বার ৫ দফায় ভোট হয়েছিল। প্রতি দফার জন্য ২০০ কোম্পানি করে বাহিনী নেওয়া হয়েছিল। তবে পঞ্চম দফায় বুথের সংখ্যা কম থাকায় একটু কম বাহিনী ছিল। সব মিলিয়ে ৮০০ কোম্পানির বেশি বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। সব মিলিয়ে বেশ কড়া হাতে সামাল দেন তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার তথা অবসরপ্রাপ্ত আইএস মীরা পাণ্ডে। ২০২৩-এ যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেখানেও সঠিক পদক্ষেপ করলে হিংসা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলেই মনে করছেন প্রাক্তন এই আমলা।
রাজ্যপাল জয়েনিং রিপোর্ট ফেরত পাঠানোর প্রসঙ্গে স্বাভাবিক ভাবে যে জল্পনার তৈরি হয়েছে তা হল রাজ্য নির্বাচন কমিশনারকে সরে যেতে হবে কি না তা নিয়ে। এই প্রসঙ্গে মীরা পাণ্ডে জানান, ‘যতদূর জানি, কমিশনার একটি সাংবিধানিক পদ। তাই তাঁকে সরাতে গেলে ইমপিচমেন্ট প্রসেসের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। হাইকোর্টের বিচারপতিকে সরাতে গেলে যে পদ্ধতি, সেই পদ্ধতিতেই সরাতে হয় কমিশনারকেও।’
তবে মনোনয়ন পর্বে যে গণ্ডগোল হয় সেই প্রসঙ্গে প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার জানান, প্রত্যেকবার ভোটে ছবিটা বদলে যাচ্ছে। কোনও কোনও জায়গায় বেশি গণ্ডগোল হচ্ছে। আবার এমন কিছু জায়গা আছে, যেখানে প্রতিবারই গণ্ডগোল হয়। সেই সব এলাকাগুলো চিহ্নিত করে কমিশনকে মূল্যায়ন করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এবার ভোটার ও বুথের সংখ্যা বেড়েছে। তাই কমিশনকে বেশি ভোটকর্মী আনতে হবে বলেও ধারনা মীরা পাণ্ডের। এই প্রসঙ্গে তিনি এও জানান, ‘নিরাপত্তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা প্রয়োজন। শুধু বুথেই নয়, মোবাইল ভ্যানে, সেক্টর অফিসেও নিরাপত্তা দরকার আছে। আর এবার একদিনে পুর নির্বাচন। তাই আলাদাভাবে মূল্যায়ন করতে হবে কমিশনকে। যত নিরাপত্তা বাহিনী দরকার, তার ওপর কিছু রিজার্ভে রাখতে হয়। সেটা একটা অঙ্কের ব্যাপার।‘ তবে পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেক নির্বাচনেই কিছু না কিছু ঘটে বলে মন্তব্য করেন মীরা পাণ্ডে। তাঁর মতে, পঞ্চায়েত নির্বাচন অর্থাৎ যে ভোটে গ্রামের লোক খুব কাছ থেকে প্রার্থীকে চেনে, সেখানে হিংসার ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তবে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ করলে পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।
এরই রেশ ধরে কমিশনের কার্য এবং দায়বদ্ধতা নিয়ে বলতে গিয়ে রাজ্যের প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার জানান, ‘কমিশনটা তৈরি করা হয়েছে সুষ্ঠ নির্বাচনের জন্য। তবে প্রতিটি নির্বাচনে পরিস্থিতি বদল হয়। কমিশন সেগুলো দেখেই সিদ্ধান্ত নেয়। কমিশন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তাকে আইন মেনেই সবটা করতে হয়। তবে যে সব ঘটনা ঘটছে, তা দেখে যদি কারও মনে হয়, কমিশন দায়বদ্ধতা থেকে সরে যাচ্ছে তাহলে সেটা দুর্ভাগ্যজনক।‘