লকেট, রচনা, দেব, হিরণ-এদের মধ্যে পুরোদস্তুর রাজনীতিতে আছেন লকেট এবং হিরণ। কারণ এনারা সার সত্যটা বুঝে গেছেন যে, রুপোলি পর্দায় আর ফেরা হবে না। দুজনেই যখন রাজনীতিতে এসেছেন তখন এঁদের টলিউড জীবনে গ্রহণ লেগে গেছে। এরপর বেশ বুদ্ধিমানের মতোই টেনে হিঁচড়ে তাকে না বাড়িয়ে বিকল্প পথ বেছে নিয়েছেন। দেব তাঁর খ্যাতির দ্বিপ্রহরেই এই ময়দানে এসেছেন। রাজনীতি তাঁর কাছে আরও একটা কাজ কিন্তু তা কখনই তাঁর সিনেমার থেকে বড় কিছু নয়। সিনেমা আর রাজনীতির মধ্যে বাছতে দিলে তিনি এক মূহুর্ত সময় নেবেন না সিনেমা কে বাছতে, এটা আমার মতো আরও অনেকেই মনে করেন। বাকি রইলেন রচনা বন্দ্য়োপাধ্য়ায়। এখনও দিদি নম্বর ওয়ানের বাইরে অস্তিত্বই নেই। জিতলে অনিবার্য আরেকজন নুসরত বা মিমি। তবে এঁদের মধ্যে সবচেয়ে ইমেজ কনসাস নিশ্চিতভাবেই দেব। জামা কাপড় থেকে জুতো, ঘড়ি, টুপি, হাঁটা, হাঁসা, কথা বলা সবখানেই উনি যে নায়ক তা বুঝিয়ে দেন প্রতিপদে। আর রচনা দিদি নম্বর ওয়ান সেটের মধ্যেই আছেন। অন্যদিকে হিরণ নেতা হতে চান, রাজনৈতিক নেতাসুলভ ব্যবহার করেন আর পরক্ষণেই তাঁর মনে পড়ে যায় তিনি হিরো হিরণ। তখনই নজরে আসে এক দোনোমনো ভাব। এখনও তিনি নেতা আর অভিনেতার মাঝখানে দোদুল্যামান এক অবস্থায়। সেদিক থেকে লকেট ১০০ শতাংশ রাজনৈতিক নেতা। অ্যাভারেজ নেতাদের প্রতিটা বিষয় ওনার মধ্যে দেখতে পাবেন। কেবল নিজের অজান্তেই ইমোশন আনতে গিয়ে ওভার অ্যাকটিং করে ফেলেন। এছাড়া তিনি নিজেকে রাজনীতির জন্য ঠিকঠাকভাবেই তৈরি করেছেন। এই চারজনের মধ্যে তিনিই একমাত্র যিনি চলতি বিষয়ে ১০/১২ মিনিট একনাগাড়ে বক্তৃতা দিতে পারবেন, সেই শিক্ষা তিনি অর্জন করেছেন। আজ এই চারজনই এবারে নির্বাচনে প্রার্থী কেবল নয়, একে অন্যের বিরুদ্ধে প্রার্থী, দুজন হারবেন, দুজন জিতবেন।
এই চার তথাকথিত রুপোলি পর্দার তারকার মধ্যে রচনা রামনবমীতে ভদ্রেশ্বরে হনুমান মন্দিরে সাত সকালে পৌঁছে গিয়েছিলেন। সেখানেই রাম সীতা হনুমানের পুজো সেরে তিনি প্রচারে বের হলেন। আচ্ছা এর আগে কস্মিন কালে তাঁর একটাও ছবি কি আমরা দেখেছি এই রামনবমীতে তিনি গেছেন হনুমান মন্দিরে! ভোট বড় বালাই। একই হুগলি কেন্দ্রে লকেটকে দেখা গ্যালো চুঁচড়ার কাপাসডাঙার এক মন্দিরে, তিনিও ছবি তুলিয়েছেন, পুজো সেরে প্রচারে বেরিয়েছেন। রাজনীতিতে আসার আগে এমন ছবি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। গত তিন চার বছর ধরে রামনবমীর দিনে লকেটের শোভা যাত্রা বা এ ধরণের ছবি দেখা যাচ্ছে। এখন তিনি পুরোদস্তুর বিজেপি। এরপরে হিরণ, যতদিন হিরো ছিলেন ততদিন উনি সকালে ১৯ টা ডিমের সাদা অংশ খেয়ে শরীর তৈরি করছেন এমন সব গোছের খবর দেখেছি, কিন্তু রামমন্দিরে? রামনবমীতে? না দেখিনি। এবারে তিনি ঘাটালে বিবেকানন্দ মোড় থেকে রমনবমীর বিরাট শোভাযাত্রায় হাঁটলেন এবং বিজেপি হয়ে ওঠার আবশ্যিক শর্ত হিসেবেই বিষ ছড়ালেন। বললেন এখানকার সাংসদ ফাটা জিনস পরে ইদের নামাজে আসেন। এই প্রথম রামনবমীতে এলেন। হ্যাঁ দেবও তার আগের দিন ওই ঘাটালের কুশপাতা এলাকাতে তৃণমূলের আয়োজিত রামনবমীর শোভা যাত্রাতে হাঁটলেন, বলেছিলেন, জয় শ্রীরাম। বলেছিলেন রাম নিয়ে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা উচিত নয়। আমি নিশ্চিত এর আগে রামনবমীর শোভাযাত্রায় দেবের কোনও ছবিও কেউ দেখাতে পারবেন না। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেন ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। এবার সেই কথাই বললেন লকেট চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু ওনার কোনও ছবি কি ইদ উৎসবে আছে? নেই। ওনার দল নির্লজ্জের মত যখন ধর্ম কে ব্যবহার করে দেশের সংখ্যালঘু মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রাখতে চায়, রাখে তখন কি তিনি একটা কথাও বলেন? বলেন না। কিন্তু রামনবমীর দিনে ভোটের ময়দানে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়ছেন এমন চার প্রার্থীকেই রামনবমীর পুজো আর শোভাযাত্রাতে দেখা গ্যালো। হ্যাঁ, আমি আপনি চাই বা না চাই, বিজেপির এজেন্ডা অনুযায়ী রাম হয়ে উঠেছেন রাজনীতির ঘুঁটি, সব্বাই সেই ঘুঁটি চালছেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, ধর্ম কি তাহলে রাজনীতির অভিন্ন অঙ্গ হয়ে উঠেছে?
আসলে আমরা আমাদের অজান্তেই রাজনীতি আর ধর্মকে মিলিয়ে ফেলেছি, এবং সেই সুযোগেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মকে কাজে লাগিয়েই এক সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ চেপে বসেছে আমাদের দেশে। আজ থেকে মাত্র ১০/১৫ বছর আগে রামনবমীতে ছুটিও থাকতো না এ রাজ্যে। দু একটা ছোটখাটো মিছিল বের হত, তাও অবাঙালি অঞ্চলে। আর এখন তা রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আমাদের ছোটবেলায় রাম-লক্ষণ আমাদের সঙ্গেই থাকতো, আমরা ভয় পেলে বলতাম ভূত আমার পুত, পেত্নি আমার ঝি, রাম লক্ষণ সাথে আছে করবি আমার কী? কিন্তু তা বলার জন্য রাস্তায় শোভাযাত্রায় হাঁটতে হতো না, নির্বাচনের প্রচারে তেনাদের আনতে হতো না।