অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটিয়ে মানুষের সম্পদ সৃষ্টিতে দুই সরকারই ব্যর্থ, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এটা স্পষ্ট। তবে, একটা উন্নয়ন নজর কেড়েছে, তা হল শাসকদলের তা কেন্দ্র বা রাজ্য যাইহোক না কেন তার জনপ্রতিনিধিদের সম্পত্তির বৃদ্ধি। ২০১৯ সালে নির্বাচন কমিশনকে তাঁরা সম্পত্তির যে হিসেব দিয়েছিলেন আর ২০২৪-এ মনোনয়নের সময় তাঁরা যে হিসেব দিলেন, সেখানে সম্পত্তি বৃদ্ধির ফারাকটা সবারই নজর কেড়েছে। এই বৃদ্ধির সঙ্গে সাধারণ জনগণের সম্পদ বৃদ্ধির একটা তুলনামূলক বিচার করতে পারলে বোঝা যাবে জনপ্রতিনিধিরা শুধুই নিজেদের সম্পত্তি বাড়িয়েছেন, না তাঁরা যাদের প্রতিনিধি সেই মানুষদেরও সম্পদবৃদ্ধিতে সাহায্য করেছেন। আগে দেখে নেওয়া যাক এই ৫ বছরে সাধারণ মানুষের সম্পত্তি কতটা বেড়েছে। তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বেছে নেওয়া হয়েছে অর্থনীতির প্রাথমিক বা কৃষিক্ষেত্রের প্রতিনিধিকে, নেওয়া হয়েছে মাধ্যমিক ক্ষেত্রের ২ জনকে। একজন শিল্পশ্রমিক অপরজন ছোট কারখানার মালিক। বেসরকারি হোটেল মালিক ও সরকারপোষিত স্কুলের শিক্ষিকাকে সেবাক্ষেত্রের উদাহরণে ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রথম উদাহরণঃ বীরভূমের মুরারই-এর প্রান্তিক চাষি। বর্তমান রেকর্ড বলছে তাঁর নামে রয়েছে ৬ বিঘে চাষের জমি। ২০১৯ সালেও এটাই ছিল। অভাবের তাড়নায় তিনি ১০ কাঠা জমি অপরের কাছে বন্ধক রেখেছেন। সেটা কোভিড-পরবর্তী সময়ের ঘটনা। ২০১৯ সালে স্ত্রীধন ছিল ৩ ভরি সোনা। এখনও তাই আছে তবে মেয়ের পড়াশোনার জন্য তা মহাজনের কাছে বন্ধক। বাস্তুভিটের কোনও রদবদল হয়নি। এটা বলার অর্থ দুই লোকসভা নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি খাতায়কলমে না বদলালেও, বাস্তবে কমে গেছে।
উদাহরণ -২ বালির বাসিন্দা। ওই অঞ্চলের এক ফ্যাক্টরির শ্রমিক। পিএফ, গ্র্যাচুইটি সব আছে। কোভিডকালে মালিক একদিনের জন্যও মজুরি বন্ধ করেননি। তা সত্ত্বেও অবস্থার উন্নতি নেই। ওঁর কথায় ২০১৯-এর তুলনায় মাইনে অনেকটাই বেড়েছে। এরপরও জিনিসপত্রের দাম, ছেলেমেয়ের লেখাপড়া চালিয়ে সঞ্চয় করার কথা ভাবতেই পারি না। ছোট একটা পৈতৃক বাড়ি আছে এটুকুই বাঁচোয়া। স্ত্রীধন বলতে ভরি ২ গহনা। এগুলো আগেও ছিল এখনও তাই আছে। সম্পত্তির নিরিখে, গত ৫ বছর তিনি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে।
উদাহরণ ৩ টিটাগড়ের এক ছোটখাটো কারখানার মালিক। স্ত্রী গৃহবধূ। বাড়ি ও স্ত্রীধন ২০১৯ সালে যা ছিল আজ ২০২৪ সালেও একই আছে। ২০১৯-এ ওঁর লেদমেশিন ছিল ৩টি, বর্তমানে তা ১টায় ঠেকেছে। ২টি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। ওঁর কথায় ২০২০ সালে কোভিডের পর কাজের বাজার এতটাই খারাপ হয়ে গেছে ১টা মেশিনের কাজ জোগাড় করতেই হিমসিম খাচ্ছেন। কাজের মজুরি ২০১৯ সালে যা ছিল এখনও প্রায় তাই আছে। এমন অবস্থা বহুজনের। ফলে অস্থাবর সম্পত্তি ২০১৯ সালের তুলনায় অনেকটাই কমেছে।
উদাহরণ ৪: এঁর মধ্য়মগ্রামে ছোটখাটো একটি রেস্তোরাঁ আছে। ২০১৯ সালে ওঁর স্থাবর সম্পত্তি যা ছিল আজও তাই আছে। অস্থাবর সম্পত্তির মধ্যে স্ত্রীধনের পরিমাণ একই থাকলেও সঞ্চিত অর্থ অনেকটাই কমে গেছে। ওই সময়ে ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানত ছিল প্রায় ১০ লাখ টাকা। পাঁচ বছর পরে সেই টাকা সামান্য কমে ৯ লাখে এসে দাঁড়িয়েছে। কোভিডকালে লম্বা সময় কোনও রোজগার না থাকাকেই উনি দায়ী করেছেন। সেইসময় দীর্ঘদিন ধরে ৮ জন কর্মচারির পারিশ্রমিক ও দৈনন্দিন সংসার খরচে সঞ্চিত অর্থের অনেকটাই ব্যয় হয়ে যায়। সেই ক্ষতি পূরণ করে সঞ্চয় বৃদ্ধি সম্ভব হয়নি।
উদাহরণ ৫: হাবড়া অঞ্চলের স্কুলশিক্ষিকা। সরকারপোষিত বিদ্যালয়ে চাকরি করার ফলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতি বছর তাঁর ৩ শতাংশ করে মাইনে বেড়েছে। তিনি ডিএ পেয়েছেন রাজ্য সরকারের নিয়মানুযায়ী। নিয়মিত বেতন পাওয়ায় কোভিডের প্রভাব আয়ের ওপর খুব একটা পড়েনি। নিজস্ব ফ্ল্যাট ২০১৯-এর আগেই কেনা। ২০১৯-এর পর মেয়ের জন্য ৩ ভরি সোনা কিনেছেন। সঞ্চিত অর্থ বলতে প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৬ লাখ টাকা। তবে অর্থের প্রয়োজনে প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে ঋণ করেছেন ২ লাখ টাকা।
যে ক’টি উদাহরণ সামনে আনা হল তাতে এটা স্পষ্ট যে গত ৫ বছরে অর্থনীতির যে ক্ষেত্রেকেই আলোচনায় আনুন না কেন, সেখানকার মানুষ খুব একটা নিজের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেননি। উল্টে কোভিড মহামারিতে অনেকেই স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি খুইয়ে নিজের খাদ্যের সংস্থান করেছেন বা দৈনন্দিন অন্যান্য চাহিদা পূরণ করেছেন।
সেখানে যদি জনপ্রতিনিধিদের সম্পত্তির খতিয়ান দেখি তাহলে কি ছবি ধরা পড়ছে দেখা যাক। এক্ষেত্রে তাঁদের তথ্যই ব্যবহার করা হয়েছে যাঁরা গতবারের লোকসভা নির্বাচনে লড়াই করে জিতেছিলেন এবং কোনও না কোনও স্তরে শাসকের ভূমিকা পালন করেছেন। শুধু তাই নয় এবারও তাঁরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ইতিমধ্যে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন এবং নির্বাচন কমিশনের কাছে তাঁদের বর্তমান সম্পত্তির হিসেব পেশ করেছেন। আর একটি বিষয় মাথায় রাখা হয়েছে, এদের প্রত্যেকের-ই মূল পেশা রাজনীতি।
উদাহরণ ১: ইনি হুগলির সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায়। বিজেপির প্রতিনিধি। অর্থাৎ যাঁরা কেন্দ্রে তারই প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। ২০১৯ সালে নির্বাচনের আগে তাঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মোট পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৫৯ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫৯ টাকা। ২০২৪ সালের নির্বাচনী হলফনামায় দেখা যাচ্ছে ওঁর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বেড়ে ৪ কোটি ১৪ লাখ ৮৭ হাজার ৪৬৩ টাকা হয়েছে। বৃদ্ধির পরিমাণ টাকার অঙ্কে ১ কোটি ৫৫ লাখ ২১ হাজার ৮০৪ টাকা।
উদাহরণ ২: বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায়। তিনবারের সাংসদ। এবারেও নির্বাচনে লড়াই করছেন। ২০১৯ সালে বীরভূমের সাংসদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি মোট পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৬৯ লাখ ৬৮ হাজার ৭০৫ টাকা। আর ২০২৪ সালে সেটাই বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি ২ লাখ ৫৩ হাজার ৬৪০ টাকা। অর্থাৎ ৫ বছরে সাংসদের সম্পত্তি বৃদ্ধির হার ৩৬.৪৪ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে।
উদাহরণ ৩: কৃষ্ণনগরের বিতর্কিত সাংসদ মহুয়া মৈত্র। এই সাংসদের কোনও স্থাবর সম্পত্তি নেই। সবটাই অস্থাবর সম্পত্তি। ২০১৯ সালে সেই সম্পত্তির মূল্য ২ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ২৫০ টাকা। ২০২৪-এ তা বেড়ে হয়েছে ৩ কোটি ৫০ লাখ ৬৭ হাজার ১৬৬ টাকা। এক্ষেত্রেও সম্পত্তি বৃদ্ধির আর্থিক মূল্য কম নয় ।
উদাহরণ-৪: অভিষেক বন্দ্য়োপাধ্যায়, ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ। সভাসমিতিতে এঁর দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাজ্য সরকার অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। তাই ইনি বলতে পারেন ১০০ দিনের টাকা আমরা দেব, আবাস যোজনার ঘর আমরা বানিয়ে দেব, ইত্যাদি। তবে তথ্য বলছে এঁর কোনও স্থাবর সম্পত্তি নেই। এমনকী পরিবারের কোনও সদস্যেরই স্থাবর সম্পত্তি নেই। সাংসদের কাছে যা আছে সবই অস্থাবর সম্পত্তি। নির্বাচন কমিশনের তথ্য বলছে ৫ বছরে ওঁর সম্পত্তির বৃদ্ধি বাকিদের তুলনায় অনেকটাই কম। ২০১৯ সালে ডায়মন্ড হারবারের সাংসদের অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৭১ লাখ ৪০ হাজার ৭৩৯ টাকা। ২০২৪ সালে সেটাই ১ কোটি ২৬ লাখ ২০ হাজার ২০৪ টাকা হয়েছে। তবে ওঁর ঋণ আছে ৩৬ লাখ টাকা।
দ্বিতীয় পর্যায়ে যাঁদের কথা হল তাঁরা সবাই আইনসভার সদস্য। প্রত্যেকেই কোভিডের মতো কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েও নিজেদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির অনেকটাই বৃদ্ধি ঘটিয়েছেন। এঁরা প্রত্যেকেই কোটিপতি। এই সমস্ত তথ্য পাশাপাশি রাখলে সহজেই অনুমেয়, সম্পত্তি বাড়ানোর উপায় এঁদের কাছে জানা আছে। এদিকে আমজনতার সম্পত্তির বৃদ্ধি ঘটিয়ে তাঁদের জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করার দায়িত্বও তো এঁদেরই হাতে ন্যস্ত ছিল। কিন্তু বাস্তবে ছবিটা ভড়ই ভিন্ন। আমজনতার সম্পদ বৃদ্ধি ঘটেনি। তাঁরা যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন।

