তৃণমূল সাংসদ নুসরতের বিরুদ্ধে ফ্ল্যাট দেওয়ার নামে যে কোটি কোটি টাকার প্রতারণার অভিযোগ তুলেছেন বিজেপি নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা তার শুরু ২০১৪ সালে। ঘটনার তদন্তে নেমে এমনই তথ্য মিলছে। ফ্ল্যাট দেওয়ার নামে ৪২৯ জনের কাছ থেকে বিরাট অঙ্কের টাকা নিয়েছিলেন নুসরত। আর প্রতারণার সেই টাকায় নিজের বিলাস বহুল ফ্ল্যাটটি কেনেন নুসরত। শুধু তাই নয়, এ খবরও মিলছে যে, সমবায়ে ফ্ল্যাট দেওয়ার নাম করে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের কর্মীদের থেকে টাকা তুলে প্রতারণা করেন তিনি। যে সংস্থাকে ঘিরে মূলত অভিযোগ, তার অন্যতম ডিরেক্টর নুসরত। এবার তদন্তকারীদের নজরে সেই সংস্থা। জানা যাচ্ছে, ওই সংস্থার নাম ‘সেভেন সেন্সেস ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রাইভেট লিমিটেড’।
তদন্তে এ ঘটনাও সামনে এসেছে, এই সংস্থারই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের অবসরপ্রাপ্ত বহু কর্মী অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে টাকা জমা করেছিলেন ফ্ল্যাট পাওয়ার জন্য। এই সংস্থার ডিরেক্টর ৭-৮ জন রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রাকেশ সিং। তারপরই উঠে আসছে নুসরত জাহানের নাম, যাঁদের নামে ইতিমধ্যেই আদালতে মামলা চলছে।‘সেভেন সেন্সেস ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রাইভেট লিমিটেড’ সংস্থার ঠিকানা দেওয়া হয়েছে গড়িয়াহাটের হেমন্ত মুখার্জি সরণি। কিন্তু ওই ঠিকানায় গিয়ে এমন নামে কোনও সংস্থার অফিস মেলেনি। রাকেশ সিংয়ের অফিসের সন্ধান করতে গিয়ে গড়িয়াহাট রোডের ‘পি-সিক্স’ সংস্থার হদিশ মেলে। আদতে এটি একটি প্রোডাকশন হাউজ়। যেটিরও ডিরেক্টর রাকেশ সিং। তবে কর্মীদের দাবি, এই সংস্থায় ‘সেভেন সেন্সেস’ কোম্পানির কোনও কাজ হয় না। তদন্তে জানা গিয়েছে, ‘সেভেন সেন্সেস কোম্পানি’র ডিরেক্টরা প্রচুর সম্পত্তি কেনেন। তা বিক্রি করে আবার নিজেদের নামে সম্পত্তি কেনেন। তবে নুসরতের পক্ষের আইনজীবীদের দাবি, ১ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকা দিয়ে পাম অ্যাভিনিউতে নিজেই নুসরত জাহান একটি ফ্ল্যাট কিনেছিলেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ২০১৪ সালের ঘটনা, কিন্তু ২০২৩ সালে এসে কেন এই পদক্ষেপ এ প্রসঙ্গে উত্তরে বিজেপি নেতা শঙ্কুদেব পণ্ডা জানান, ‘যে ৫০০ জনের কাছ থেকে তিনি টাকা লুটেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ১০০ জনের অন্তত মৃত্যু হয়েছে। বেশিরভাগই সবাই অবসরপ্রাপ্ত কর্মী। আর কবে তাঁরা বিচার পাবেন? সিনিয়র সিটিজেনদের তো এইটুকু ভরসা দেব।’ একইসঙ্গে এও জানান, তাঁর দাবি, যে কোনও মামলার একটা প্রসেস থাকে। ওঁরা প্রথমে গিয়েছিলেন গড়িয়াহাট থানায়। পুলিশ মামলা নেয়নি। এরপর আলিপুর আদালতে গিয়ে মামলা ফাইল করেছে। আদালত বলেছে এফআইআর করতে। এফআইআর হয়, পুলিশ রিপোর্ট জমা দেয়। আলিপুর কোর্টে দুবার সমন ইস্যু হয়। নুসরত যাননি।
এদিকে সূত্র মারফৎ খবর মিলছে, সেভেন সেন্সেস ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রাইভেট লিমিটেড’র ডিরেক্টর ছিলেন রাকেশ সিং, নুসরাত জাহান, রূপলেখা মিত্র-সহ মোট ৮ জন।
২০১১ সালে তৈরি হয়েছিল ‘সেভেন সেন্সেস’ কোম্পানিটি। সেটি মূলত ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ কোম্পানি হিসাবেই তৈরি হয়েছিল। ২০১৪ সালে অন্যতম ডিরেক্টর হিসাবে সেই কোম্পানিতেই যোগ দিয়েছিলেন নুসরত। ২০১৭ সালে পদত্যাগও করেন। তারই মধ্যে প্রতারণার অভিযোগ। অর্থাৎ সাংসদ হিসাবে শপথগ্রহণের আগেই তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগটি ওঠে। উল্লেখ্য, এই সংস্থা কলকাতাতে ব্যবসা করলেও, নথিভুক্ত ঠিকানা ভুবনেশ্বরে। তদন্তে আরও জানা গিয়েছে, রাকেশ সিংয়ের কলকাতার বুকেই আরও চারটে কোম্পানি রয়েছে। আর সেই চারটে কোম্পানিকে কাজে লাগিয়েই রাকেশ প্রতারণার জাল বিছিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
এদিকে অনুসন্ধান কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে চলতি বছরের গত ৩০ জানুয়ারি ৬ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলিপুর আদালত অভিযুক্ত সংস্থার আট জনকে ২৩ শে ফেব্রুয়ারির দিন হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু তারপরও নুসরত জাহান সেই সমনে হাজিরা দেননি। ৫ এপ্রিল নুসরাত আদালতে নিজের আইনজীবীর মাধ্যমে আবেদন জানান, সশরীরে তাঁর পক্ষে আদালতে হাজিরা দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তিনি ব্যস্ত। তিনি একজন সংসদ। তিনি বছরের বেশি সময় দিল্লি থাকেন। এছাড়াও কলকাতার বাইরে থাকেন। তবে ওই আবেদন খারিজ করে দেয় আদালত। বিচারক স্পষ্ট নির্দেশ দেন, পরবর্তী শুনানির দিন ২৭ এপ্রিল তাঁকে সশরীরে হাজির হতে হবে। কিন্তু তারপরেও হাজির হননি নুসরত। তবে এই মামলায় আদালতের নির্দেশে রাকেশ সিং-কে আগেই গ্রেফতার করা হয়েছিল।
অর্থাৎ, এর থেকে স্পষ্ট যে নুসরতের বিরুদ্ধে আগে থেকেই তদন্ত শুরু করেছিল কলকাতা পুলিশ। রাজ্য প্রশাসন গোটা বিষয়টিই জানত। কারণ জয়েন্ট সিপি ক্রাইমের নির্দেশে গড়িয়াহাট থানার সাব ইন্সপেক্টর গোটা তদন্তপ্রক্রিয়া চালিয়েছিলেন। অনুসন্ধানের রিপোর্টেও স্পষ্ট উল্লেখ ছিল, অভিযোগের সত্যতা রয়েছে। আর এখানেই প্রশ্ন উঠছে, এরপরও কেন কোনও ব্যবস্থা করা হয়নি বা কীভাবে বা আদালতের সমন এড়ালেন নুসরত তা নিয়েও। প্রশ্ন উঠছে, কেন প্রতারিতরা দ্বারস্থ হওয়া মাত্রই অভিযোগ গ্রহণ করল না গড়িয়াহাট থানা? কলকাতা পুলিশের উচ্চ পদস্থ কর্তাদেরই একাংশের ইঙ্গিত, সেখানে নুসরত জাহানের নাম থাকাতেই প্রথমটায় অভিযোগ নিতে ইতঃস্তত বোধ করেছিল থানা। পরে আদালতের নির্দেশ এফআইআর নেওয়া হয়।
এই প্রসঙ্গে রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘বিরাট দুর্নীতি। ওই বয়স্ক লোকরা আমার কাছে এসেছিলেন। সরাসরি দুর্নীতির সঙ্গে ওই সাংসদ যুক্ত। ১ কোটি ৫৫ লক্ষ টাকা একটা ফ্ল্যাটও কিনেছেন, বয়স্ক লোকগুলোর টাকা ডাইভার্ট করে। সব নথি আমাদের কাছে রয়েছে।’
নুসরতের পাম অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাট নিয়ে প্রতারিতদের আইনজীবীর বক্তব্য, ‘আসল দলিলগুলো ব্যাঙ্কের কাছে জমা দেয়। সেই দলিলগুলো এখনও আছে। কিন্তু নুসরত সার্টিফায়েড কপি বার করে জমিগুলো রিসেল করে দেয়। নুসরত নিজেই ১ কোটি ৯৮ লক্ষ টাকা দিয়ে বাড়ি করেছেন। সেই টাকা আইওবি-র অ্যাকাউন্ট থেকেই এসেছে। অ্যাসোসিয়েশনের অ্যাকাউন্টের টাকা থেকে চেক দিয়েছেন।’ তবে এসবের পরেও নুসরতের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আমল দিতে চাইছে না তৃণমূল। সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘আমি এসব ব্যাপার বিশ্বাসও করি না। আমি মনে করি না নুসরত এই ধরনের কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত। আমি টিভিতে দেখেছি ব্যাপারটা। নুসরতের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। নুসরত আমাকে বলেছে, আমি আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলছি।’