‘রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে কোনও রকম হিংসা বরদাস্ত করা হবে না, এমনই কড়া বার্তা দিতে শোনা গিয়েছিল রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসকে। তবে বাস্তব কিন্তু তা বলে না। মনোনয়ন পর্বে রাজনৈতিক অশান্তির সাক্ষী থেকেছে ভাঙড়, ক্যানিং, চোপড়া সহ রাজ্যের নানা জায়গা।ইতিমধ্যেই শুক্রবার ভাঙড় আর শনিবার ক্যানিং পরিদর্শন করে এসেছেন রাজ্যপাল স্বয়ং। শুক্রবার ভাঙড়ের মাটিতে দাঁড়িয়ে রাজ্যপাল বার্তা দেন, ‘আমি বাংলার মানুষকে আশ্বস্ত করছি, এই ভোটে হিংসাই বলি হবে। হিংসাকে নির্মূল করতে হবে। যারা হিংসা ঘটাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে সংবিধান এবং আইন মেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এরপর শনিবার যান ক্যানিংয়ে। ক্যানিংয়ের হিংসা কবলিত এলাকা ঘুরে দেখার পর তিনি রাজ্যবাসীর উদ্দেশে বার্তা দেন, ‘গণতন্ত্রে ভয়ের কোনও জায়গা নেই।‘ সঙ্গে এও জানান, তিনি হিংসা বরদাস্ত করবেন না। এরপর ক্যানিং থেকে রাজভবনে পা রেখেই রীতিমতো এক বিজ্ঞপ্তি জারি করে ‘শান্তিকক্ষ’ অর্থাৎ ‘পিস রুম’ খোলার ঘোষণাও করতে দেখা যায় তাঁকে। চালু করা হয় হেল্পলাইন নম্বরও। শুধু হেল্পলাইন নম্বরই নয়, দেওয়া হয় একটি ই-মেল অ্যাড্রেসও। সেখানে বলা হয়েছে, ভোট সংক্রান্ত অশান্তি ঠেকাতে রাজভবনে অভিযোগ জানানো যাবে। সেই অভিযোগ পেয়ে রাজ্যপালের তরফে জানানো হবে রাজ্য সরকার এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে। তারা সেই মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে।
তবে এই পিস রুম খোলা নিয়ে বঙ্গ রাজনীতিতে শুরু হয় এক মহা বিতর্ক। শাসক দলের সাংসদ শান্তনু সেন এই ‘পিস রুম’ সম্পর্কে জানান, ‘নির্বাচন কমিশনের আওতায় এখন সবকিছু। আদর্শ আচরণ বিধি বলবৎ আছে। নির্বাচন আচরণ বিধির ঊর্ধ্বে কেউ নন, স্বয়ং রাজ্যপালও নন। সুতরাং এই সময় এটা কতটা করা যায় আমার জানা নেই। রাজ্যপাল অতি উৎসাহী হয়ে যেভাবে এ সমস্ত কাজকর্ম করছেন। এদিকে এত বড় রেল দুর্ঘটনা ঘটল, এই উৎসাহ তো দেখা গেল না। এত মানুষের প্রাণ বিপন্ন হল, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছুটে গেলেন। তখন কোথায় ছিলেন উনি? সাংবিধানিক প্রধান হিসাবে ওনার উচিত, নিজের এক্তিয়ারে থেকে প্রশাসনিক প্রধান ও নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করা।’ প্রায় একই সুর রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী স্নেহাশিস চক্রবর্তীর গলাতেও। স্নেহাশিস চক্রবর্তী জানান, ‘রাজ্যপালের কোনও অধিকারই নেই এটা করার। উনি একজন মনোনীত ব্যক্তি। সংবিধানগত ভাবে ওঁনার যে অধিকার, রাজ্য মন্ত্রিসভার সঙ্গে পরামর্শ করে তাঁকে পদক্ষেপ করতে হয়। কিন্তু বিজেপি অনৈতিকভাবে অবিজেপি রাজ্যে রাজ্যপালকে ব্যবহার করছে।‘ পিস রুমের কথা সামনে আসতেই সুর চড়িয়েছিলেন তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, ‘রাজ্যপাল বিজেপি সদস্যের মতো আচরণ করছেন। আমি তাঁর পদকে সম্মান জানাই কিন্ত তিনি নিজের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে যদি বিজেপি, সিপিএম, কংগ্রেস ও আইএসএফ যা বলছে সেটিকেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন তাহলে আমরা তার বিরোধিতা করব।‘
এদিকে রাজভবনের এই পদক্ষেপে কতটা আইনগত ভিত্তি রয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সিপিএম নেতা সুজন চক্রর্তী। বলেন, ‘এটার আইনগত ভিত্তি আছে কি না তা খতিয়ে দেখা জরুরি। সম্ভবত নেই। রাজ্যপালের কাজ এটা নয়। নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের যা দায়িত্ব, সেই আইনশৃঙ্খলা ও সেই সংক্রান্ত বিষয়ে কন্ট্রোল রুম খোলা রাজভবনের দায়িত্ব না।‘
যদিও বিজেপির একাংশের তরফ থেকে রাজভবনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়। একাংশ বলার কারণ, এই ‘পিস রুম’ সম্পর্কে বিজেপির অন্দরেই নানা মুনির নানা মত। রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের বক্তব্য, ‘যা শুনছি হেল্পলাইন চালু হতেই প্রচুর অভিযোগ ইতিমধ্যেই এসেছে। বাড়িতে ভাঙচুর, মনোনয়ন জমা দিতে না পারা, ছেলেমেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার মতো অভিযোগ এসেছে বলে শুনেছি।’ এদিকে রাজভবনের ‘পিস রুম’-এর ব্যবহারিক দিক নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে দেখা যায় বিজেপির সর্বভারতীয় সহসভাপতি দিলীপ ঘোষকে। তাঁর মতে, ‘রাজ্যপাল তাঁর মতো করে কিছু একটা করেছেন। কিন্তু তাঁর সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি সরকারকে নির্দেশ দিতেই পারেন, কিন্তু সেই নির্দেশ সরকার মানবে, তার কী মানে আছে?’
তবে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী ‘পিস রুম’-এর এই পদক্ষেপকে কটাক্ষ করে জানান, ‘শান্তি ভবন শান্তি ভবনেই থাকবে। অশান্তি মেটানোর কোনও ব্যবস্থা হবে না। রাজভবনে একটা শান্তিভবন খুললাম, এটা কোনও অ্যাকশন নয়। কিছুই হবে না।‘ পাশাপাশি অধীর রঞ্জনের গলাতেও শোনা যায় বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতির মতোই প্রশ্ন। তাঁর জিজ্ঞাসা, ‘রাজ্যপালকে মানে কী এই সরকার?’
ফলে রাজ্য়পাল পদক্ষেপ নিলেও বড্ড ধোঁয়াটে জায়গায় অবস্থান করছে এই ‘পিস রুম’। অভিযোগ জমা পড়লেও কাজের কাজ কতটা হবে তা নিয়ে সন্দিহান যে বিরোধী শিবিরই।