বাঙালির দুর্গাপুজো অন্তরে অনুভব করতে হল কলকাতার পুজো নয়, আসতে হবে গ্রামের পুজোয়। যেখানে আর্থিক বৈভব নেই, আছে মায়ের আরাধনায় এক আকুলতা।পুজোর ভাবগম্ভীর পরিবেশকে অন্তরের গহীনে অনুধাবন করতে হলে পা রাখতেই হবে এই গ্রামের পুজোয়। তবেই বোঝা যাবে গ্রামবাংলার পুজোর মাধুর্য। বোঝা যাবে বাংলার সংস্কৃতি। কারণ, কলকাতার পুজোর জৌলুস চোখ ধাঁধানো হলেও সেখানে ‘সর্বজনীন’ হয়ে ওঠার ছবিটা কোথাও একটু হলেও উধাও। গ্রাম বাংলার এই পুজো বাড়ির পুজো বলে পরিচিত পেলেও বাস্তবিক অর্থে তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। অর্থাৎ সর্বজনের হিতায়ে হয় এই পুজো। দীর্ঘকাল ধরে এই সব পুজো চলে এলেও তাদের সম্পর্কে জানতে পারেন না কেউই। কারণ এই সব পুজোর উদ্যোক্তারা প্রচার বিমুখ। ফলে এই ধরনের পুজো কখওনই থাকেনি প্রচারের আলোয়। এই রকমই এক ঐতিহ্যমণ্ডিত পুজো অনুষ্ঠিত হয় হুগলির গুড়াপ থানার চোপা গ্রামে। যা স্থানীয়দের মধ্যে পরিচিত মজুমদার বাড়ির পুজো বলেই। চোপা গ্রামের মজুমদার বাড়ির পুজো ঠিক কত বছর আগে শুরু হয়েছিল সে ব্যাপারে খুব একটা নিশ্চিত নন বর্তমান প্রজন্মও। তবে এই পুজো যে শতাব্দী প্রাচীন সেক্ষেত্রে নিশ্চিত প্রত্যেকেই। তাও এই পুজো সম্পর্কে মজুমদারের পরিবারের সদস্যরা যেটুকু জানালেন তা হল, চোপা গ্রামের মজুমদার বাড়ির পুজো শুরু আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে জমিদার রাধিকা প্রসন্ন মজুমদারের হাত ধরে। ফলে এই পুজোর শুরুর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক ইতিহাস। জমিদার রাধিকা প্রসন্নর হাতে এই পুজোর শুরু হলেও পরবর্তীকালে তাঁর বংশধরেরা বিলুপ্ত হন। এরপর যাঁদের হাতে এই পুজো এসে পড়ে তাঁরা রাধিকা প্রসন্নর বংশধর না হলেও তাঁরই পরিবারের শাখা-প্রশাখার অংশ। এর মাঝে এই পুজো বন্ধ হয়ে যায় রক্ষণবেক্ষণের অভাবে মন্দির ভেঙে পড়ায়। এই সময় মজুমদার পরিবারের এক সদস্য গুণেন্দু মজুমদার অধিষ্ঠাত্রী দেবীকে নিয়ে কলকাতায় চলে আসতে চান। তবে তাঁর এই পরিকল্পনাকে ভেস্তে দেন এই পরিবারেরই অন্যান্য সদস্যরা। মজুমদার পরিবারের এক সদস্য রঞ্জিত মজুমদার একটি টালির ঘর কোনওমতে তৈরি করে পুজো ফের শুরু করেন। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই টালির ঘর পাকা মন্দিরের রূপ নেয়। ২০০০ সাল নাগাদ তৈরি হয় মন্দিরের স্থায়ী এক কাঠামো। আপাতত মজুমদারদের ছ’টি ঘর একযোগে এই পুজো সামাল দেন। এই ছটি পরিবারের কর্তারা হলেন প্রশান্ত মজুমদার, রঞ্জিত মজুমদার, উদয় মজুমদার, তপন মজুমদার, শ্যামল মজুমদার এবং গোপাল মজুমদার। আর প্রতি বছর এক-একটি পরিবারের হাতে পড়ে পুজোর পালা। ফলে আপাত দৃষ্টিতে এঁরা সে অর্থে একান্নবর্তী পরিবার না হলেও মায়ের আরাধনায় একে অপরের পাশে এসে দাঁড়ান নিসংকোচে-নির্দ্বিধায়। মায়ের পুজোর খরচ সমানভাবে নিজেদের মধ্যে বন্টনও করে নেন এঁরাই।
বহু প্রাচীন পুজো হলেও এ নিয়ে কাউকে খুব একটা মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। কারণ, মজুমদার বাড়ির সদস্যরা তাঁদের এই পুজো সম্পর্কে বড়ই প্রচার বিমুখ। এই দুর্গাপুজো যেন তাঁদের কাছে এক পারিবারিক অনুষ্ঠান মাত্র। যেখানে মেয়ে বছরের চারটে দিনের জন্য আসেন তাঁর পিতৃগৃহে। আর এই চারটে দিন তো শুধু দুর্গাপুজো নয়, মেয়েরূপী দুর্গার যত্নআত্য়ি করতেই কোথায় যে সময় কেটে যায় তা বুঝে উঠতে পারেন না মজুমদার পরিবারের সদস্যরা। ফলে দেবী দুর্গার আরাধনাকে ছাপিয়ে যেন মূর্ত হয়ে ওঠে বাড়ির মেয়ের দুর্গার অবস্থান। ঠিক যেমনটি হয় যে কোনও আটপৌরে বাঙালি বাড়িতে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে এলে। শুধু কন্যাই বা বলি কেন, মজুমদার বাড়িতে আবার কারও কাছে তিনি মাতৃস্বরূপাও। দুর্গতিনাশিনী। সর্ব সঙ্কট মোচন করতেই তাঁর আসা। এই চারটে দিন বাড়ির মেয়ে পূজিতা হন ত্রিগুণময়ীরূপে। এই দুর্গা, লক্ষ্মী এবং সরস্বতী হলেন ভগবানের চিৎশক্তি বা স্বরূপশক্তির ছায়াস্বরূপা এবং জড়জগতের অধিষ্ঠাত্রী। মায়ের বামে সিদ্ধিদাতা বিঘ্নহর্তা গণেশ এবং ডানে শৌর্য বীর্যের প্রতীক দেবসেনাপতি কার্তিক। এই চার দেবতা যেন সমাজের চারবর্ণের প্রতীক। সমাজের চারবর্ণ হল বুদ্ধিজীবী- ব্রাহ্মণ, শাসকশ্রেণি-ক্ষত্রিয়, বৃত্তিজীবি-বৈশ্য এবং শ্রমজীবি- শূদ্র। সরস্বতী বুদ্ধি ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী ও সত্ত্বগুণস্বরূপিণী। তাই তিনি ব্রাহ্মণগণের প্রতীক। বীরত্ব ও তেজের প্রতীক কার্তিকেয় ক্ষত্রিয় শক্তির প্রতিনিধিত্ব করছেন। দেবী লক্ষ্মী অন্ন, শস্য, সমৃদ্ধি ও ধনসম্পদের অধিষ্ঠাত্রী যা বৈশ্যদের দ্বারা সম্পাদিত কৃষিকাজ ও ব্যবসার মাধ্যমে পূর্ণ হয়। আর গণপতি গণেশ যেন গণদেবতারূপে শ্রমিকশ্রেণিকে বা শূদ্রদের কর্মদক্ষতা প্রদান করছেন। চারটি বর্ণেরই গুরুত্ব আছে। শরীরে মাথার যেমন প্রয়োজন তেমনি পায়েরও প্রয়োজন। সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিকমতো কাজ করলে তবেই শরীর সুস্থ থাকবে। বেদে দেবী দুর্গা বলেছেন- ‘অহং রাষ্ট্রী’- তেমনি এই চারবর্ণ সঠিকভাবে কাজ করলেই রাষ্ট্র উন্নত হয়। দেবীর পদতলে শূলবিদ্ধ অবস্থায় মহিষাসুরের অবস্থান। দেবীর বাহন সিংহ অসুরকে আক্রমণে উদ্যত। এখানে পশুরাজ সিংহটি আমাদের মনের প্রতীক। যদি আমরা আমাদের পশুরাজ সিংহরূপী মনের উপর ধর্মরূপী দেবীকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি, তবে তিনি আমাদের মনের অসুররূপী আসুরিক প্রবৃত্তিগুলাকে শূলাঘাতে বিনষ্ট করবেন। আর এই বিশ্বাসেই দেবী দুর্গার সঙ্গে তাঁর গোটা পরিবার আসেন এই চোপা গ্রামের মজুমদার বাড়িতে। মা দুর্গার সঙ্গে আসেন লক্ষ্মী-সরস্বতী, কার্তিক-গণেশ। একচালার দুর্গা ঠাকুরের চালচিত্রের উপরে শিব। এমনকী সব দেবদেবীর বাহনরাও থাকে দুর্গাপুজোর মূর্তিতে। দুর্গার বাহন সিংহ, লক্ষ্মীর পেঁচা, সরস্বতীর হাঁস, গণেশের ইঁদুর, কার্তিকের ময়ূরও ঠাঁই পায় দুর্গার সঙ্গে সঙ্গে। ফলে অতি সাধারণ এক বাঙালি পরিবারের মতো বাড়ির মেয়ের নিজের ঘরে আসাকে এক স্বাভাবিক ঘটনা বলেই মনে করেন মজুমদার পরিবারের সদস্যরা।
এখানে একটা কথা না বললেই নয়, রাধিকা মজুমদারের হাতে এই পুজোর শুরু সময় যাঁরা এই পুজোয় অংশ সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন মজুমদার বাড়ির তরফ থেকে তাঁদের দান করা হয়েছিল জমি। ঢাকি, পুজোয় অংশ নেওয়া নাপিত এবং ঠাকুর গড়ার মাটি যিনি মাখতেন তাঁদের প্রত্যেককেই ১০ কাঠা করে জমিও দান করা হয়েছিল। একইসঙ্গে এই জমি দেওয়া হয়েছিল যিনি এই পুজোয় মিষ্টান্নের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁকেও। আর এই পুজোয় যাঁরা প্রথম থেকে ছিলেন তাঁদের বংশধরেরা এখনও প্রত্যেকেই অংশ নেন এই পুজোয়। যেমন, এই পুজোর প্রতিমা তৈরি করেছিলেন বর্ধমানের জামালপুরের নিরাপদ দে। এখনও তাঁদের বংশধরেরাই এই প্রতিমা গড়ার কাজ করে চলেছেন। একই ছবি ধরা পড়ে ঢাকিদের ক্ষেত্রেও। শিবু দাসী রুইদাস এবং মনসা রুইদাসের পরিবারের হাতেই থাকে পুজোয় ঢাক বাজানোর দায়িত্ব। কারণ, এঁদের বিশ্বাস, এই পুজোয় অংশ নিলে সফলতা অবশ্যম্ভাবী। ফলে মনের এই গভীর বিশ্বাস থেকে এই পুজোয় অংশ নেন গ্রামের অনেকেই। আর এইভাবেই মজুমদার পরিবারের পুজো চোপায় রূপ পেয়েছে এক পারিবারিক পুজোর।
এখানে মজুমদার বাড়ির পুজো সম্পর্কে একটা তথ্য দিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। মূলত ছ’টি পরিবারে বিভক্ত এই মজুমদার পরিবার। আর প্রতি বছর এই পুজোর দায়িত্ব পড়ে এক পরিবারের ওপর। ২০২৪-এ মজুমদার বাড়ির এই পুজো ২০২৪-এর পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন প্রদীপ মজুমদার এবং সুব্রত মজুমদার। ২০২৪-এর পুজো সম্পর্কে সুব্রতবাবু জানান, মাতৃপ্রতিমা রূপদানের ক্ষেত্রে ট্র্যাডিশন বজায় রাখা হচ্ছে। আর এই পুজো হয় বৈষ্ণব মতে। কারণ, মজুমদার বাড়িতে অধিষ্ঠান করছেন বহু দেবদেবীর সঙ্গে গোপালও। সেই কারণেই মায়ের পুজোতে বলি হিসেবে কোনও প্রাণীকে বলি দেওয়া হয় না কখনও-ই। প্রাণীর বদলে সেখানে ব্যবহার করা হয় কোনও সবজি বা ফলকে।
এক সময় এই পুজো হতো ১০০ টা ল্যাম্পের আলোয় আজ সেই পুজো প্রাঙ্গন ভরে ওঠে বিদ্যুতের আলোয়। সময়ের তালে পুজোয় আড়ম্বর বেড়েছে। আর পুরোহিতরাও যে ক্রমেই ‘প্রফেশনাল’ হয়ে যাচ্ছেন তা লুকোননি সুব্রতবাবু। আর এই পুজোকে ঘিরেই মজুমদার বাড়িতে হয় এক গেট-টুগেদারও। ভারতের বিভিন্ন জায়গা বা বিদেশেও যাঁরা রয়েছেন তাঁরা এসে চোপা গ্রামে হাজির হন এই পুজোকে ঘিরেই। পুজোর চারটে দিন কাটে হৈ-হুল্লোড়ে। নবমীতে হয় এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। এরপর দশমীতে মাকে সিঁদুর খেলা আর বরণের মধ্য়ে দিয়ে তাঁকে জানানো হয় বিদায় বেলা আসন্ন। মায়ের এই নিরঞ্জনও হয় বেশ ঘটা করেই। একেবারে ব্যান্ড বাজিয়ে মাতৃ প্রতিমার নিরঞ্জন হয় স্থানীয় এক পুকুরে। এতো মজুমদার পরিবারের পক্ষ থেকে মাকে বিদায় জানানো নয়, তাঁকে ফের আবাহন জানানো সামনের বছরের জন্য। মায়ের কানে-কানে তাই বাড়ির বউয়েরা জানান, ‘আবার আসিস মা’।