সাবেকিয়ানার ট্র্যাডিশন ধরে থিমকে চ্যালেঞ্জ কুমিল্লাপাড়া পল্লীমঙ্গল সমিতির 

দুর্গাপুজোয় কলকাতায় যেতেই হবে, না হলে পুরো মাটি। এমন একটা ধারনা তৈরি হয়ে গেছে আমবাঙালির। এবার এই ধারনাতে ফাটল ধরাতে হাজির কুমিল্লাপাড়া পল্লি মঙ্গল। হাজারো প্রতিবন্ধকতা থাকলেও জমকে-চমকে এখানকার পুজো কোনও অংশেই কম নয়। বরং বাঙালির ঐতিহ্যকে ধরে রাখছে শহরতলির এই সব পুজোই।  হাতে গোনা কয়েকটি পুজো বাদ দিলে জেলা বা শহরতলির পুজোর প্রথম সমস্যা হল তাদের বাজেট। কলকাতার পুজোর উদ্যোক্তারা এই পুজোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সূত্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকেন তার কণামাত্রও এসে পৌঁছায় না শহরতলির এই সব পুজো উদ্যোক্তাদের কাছে। ফলে তাঁরা তাঁদের সীমিত সাধ্যের মধ্যে থেকে নজর কাড়া পুজো করেন। আর এই ট্র্যাডিশন চলে আসছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। শহরতলির পুজো বা জেলার পুজোর আরও একটা বড় প্রতিবন্ধকতা হল প্রচারের আলো না পাওয়া। ফলে চোখ ধাঁধানো পুজো মণ্ডপ বানানো বা নজর কাড়া প্রতিমা গড়েও এই সব পুজো সম্পর্কে জানতে পারেন না অনেকেই। এই তালিকা থেকে বাদ পড়ছে না বেলুড়ের কুমিল্লা পাড়া পল্লীমঙ্গল সমিতির সর্বজনীন পুজোও।

তবে ২০২৪-এ কুমিল্লা পাড়া পল্লীমঙ্গল সমিতির পুজো না দেখলে যে পুজোর আনন্দে অনেকটাই খামতি থেকে যাবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। কারণ, বহুবিধ। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, এই পুজো হালফিলের পুজো নয়। ২০২৪-এ এই পুজো পা রাখছে ৭৪ বছরে। এখানে পুজো উদ্যোক্তারা তাঁদের পরিকল্পনায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তুলে ধরছেন বাঙালির সাবেকিয়ানাকেই। থিম পুজো নিয়ে মাতামাতি হলেও সেই পথে হাঁটতে একেবারেই নারাজ এই পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা। থিম পুজোকে কোন অংশে ছোট না করেই পুজো কমিটির সদস্য় পার্থ সেনগুপ্ত জানান, ‘সাবেকিয়ানার মধ্যে রয়েছে বাঙালির ঐতিহ্য। শুধু তাই নয়, এই সাবেকিয়ানা পুজো প্রাঙ্গনে এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ তৈরি করে। যা একান্ত কাম্য দুর্গাপুজোয়। আর সেই কারণেই থিম পুজো করার মতো জায়গা থাকলেও সে পথে হাঁটতে রাজি নয় কুমিল্লা পাড়া পল্লীমঙ্গল। বরং পুজোর প্রতিমা থেকে মণ্ডপ সবেতেই এবারও থাকছে সাবেকিয়ানার ছোঁয়া।’

কুমিল্লা পাড়া পল্লীমঙ্গল সমিতির পুজো হয় একটা ছোট মাঠে। এবারের পুজো মণ্ডপে এলে দেখা যাবে শোলার ওপর পুঁতি আর জরির কাজ। সঙ্গে থাকছে প্য়াঁকাটির কাজও। সাবেকি হলেও নানা ধরনের হাতের কাজে এই মণ্ডপ যে দর্শনার্থীদের নজর কাড়বে সে ব্যাপারে নিশ্চিত পুজো কর্তারা। এই পুজো মণ্ডপ তৈরির ভার দেওয়া হয়েছে পূর্ব মেদিনীপুরের মাইতি ডেকরেটর্সকে। মণ্ডপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে থাকছে আলোক সজ্জাও। এই আলোক সজ্জাতেও থাকছে সাবেকি ছোঁয়া। তবে সামগ্রিক আলোক সজ্জা তৈরি হয়েছে একটা থিমকে কেন্দ্র করেই। অর্থাৎ,আলোক সজ্জা সজ্জিত হচ্ছে যেন অদৃশ্য এক সুতোয় গেঁথে। কুমিল্লা পাড়া পল্লীমঙ্গলের এই আলোক সজ্জা নস্ট্যালজিয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে দর্শনার্থীদের। কারণ, চন্দননগরের আলোক সজ্জা হিসেবে খ্যাত সেই পুরনো দিনের গেট, কল্কা, আলোর খেলা পৌঁছে দেবে বিংশ শতাব্দীর দুর্গাপুজোর আলোকজ্জ্বল পরিবেশে। সময়ের সঙ্গে দুর্গাপুজোতে চন্দননগরের এই আলোক সজ্জায় কোথাও যেন এক ভাটার টান। আলোক সজ্জাও যে দুর্গাপুজোর একটা বড় অঙ্গ তা ভুলতে বসেছেন দর্শনার্থীরা। আর সেই কারণেই এবারের কুমিল্লাপড়ার পল্লীমঙ্গল সমিতির এই আলোকসজ্জা এক বড় আকর্ষণ দর্শনার্থীদের কাছে। এর দায়িত্বে রয়েছেন স্থানীয় শুড়ো ইলেকট্রিক।

এরই পাশাপাশি সব কিছুর সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে প্রতিমাও। যার রূপদান করছেন কুমোরটুলির প্রখ্য়াত মৃৎশিল্পী মোহন বাঁশি রুদ্র পাল। সাবেকি প্রতিমা।  প্রতিমায় সর্বমঙ্গলদায়িনী দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধের মধ্য দিয়ে বরাভায় দান করছেন, সেটাই ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। ছোট্ট আলাপচারিতায় পুজো উদ্যোক্তারা এও জানান, মণ্ডপে মাতৃপ্রতিমা দর্শনের পর মন ভরে যাবে আধ্য়াত্মিক এক অনুভূতিতে। যে অনুভূতি থিমের প্রতিমায় আনা বেশ কষ্টসাধ্য।

৭৪ বছরে পা দেওয়া এই পুজো কলকাতার পুজোকে যে চ্য়ালেঞ্জ জানাচ্ছে তা বোঝা গেল কুমিল্লা পাড়া পল্লীমঙ্গল সমিতির কর্তাদের সঙ্গে আলাপচারিতায়। তবে সেখানে কোথাও একটু হলেও ধরা পড়ে হতাশা। এই প্রসঙ্গে পুজোর কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে প্রদীপ নন্দী জানান, ’কলকাতার পুজোর বেশির ভাগ-ই বিগ বাজেটের পুজো। যে সব পুজো কলকাতায় ছোট পুজো বলে পরিচিত তাদের বাজেটের সমান এবার ৭৪ বছরে পা রাখা বেলুড়ের এই পুজো। বাজেট সর্বসাকুল্য়ে ১০ লাখ টাকা। আর এই টাকা ওঠে কর্মকর্তাদের হাত ধরেই। সে অর্থে বড় স্পনসর নেই। তবে এখানকার পুজোয় যেটা আছে তা হল মন ছুঁয়ে যাওয়া পরিবেশ। পুজোর ক’টা দিন এই পুজোকে ঘিরে এলাকাবাসী যেন আবদ্ধ হন এক পারিবারিক বন্ধনে। এই কয়েকটা দিন স্থানীয়রা ‘কুমিল্লা পাড়া পল্লীমঙ্গল সমিতি’ নামে পরিবারেরই  সদস্য। পুজো মণ্ডপে সবার জন্য পুজোর ভোগের রাখা হয় ব্যবস্থা। ফলে কারও বাড়িতে রান্না হয় না বললেই চলে।’

আর এই পুজোর আরও একটা বড় দিক হল প্রবীণদেরকে বিশেষ জায়গা দেওয়া বা তাঁদের মতামত নেওয়াও। কারণ, তাঁদের আশীর্বাদ এবং অভিজ্ঞতা সমগ্র বিষয়ে বর্তমান প্রজন্মকে যে যোজন খানেক এগিয়ে রাখবে তা তাঁরা বোঝেন অন্তর থেকে। আর সেই কারণেই পুজো উদ্বোধন থেকে প্রতিমা নিরঞ্জনে প্রবীণদের একটা আলাদা জায়গা থাকে এই পুজোতে।

এদিকে কেমন কাটছে পুজো ২০২৪-এর সেই সম্পর্কে পুজো কর্মকর্তা কেশব রায় জানান, ‘ অন্যান্যবারের মতো এবছরেও চতুর্থী থেকে ষষ্ঠী পর্যন্ত পুজো প্রাঙ্গন ভরিয়ে রেখেছে এলাকার কচিকাঁচারাই। শুধু তাই নয়, পুজোর ক’টা দিনেও নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন রেখেছেন এলাকার মহিলারাও। তবে প্রত্যেকেই অপেক্ষা করে আছেন ধুনুচি নাচ দেখার জন্য। কারণ, এর মধ্যে থাকে মায়ের প্রতি অদ্ভুত এক শ্রদ্ধা, আবেগ, ভালোবাসা। এই শ্রদ্ধা আর ভালোবাসারই এক ভক্তিপূর্ণ নিবেদন ঘটে এই ধুনুচি নাচের মধ্য দিয়ে। ধুনুচি নাচে শুধু যে পুরুষেরাই অংশ নেন তা কিন্তু নয়, অংশ নেন মহিলারাও। ফলে সব মিলিয়ে এক নজর কাড়া অনুষ্ঠান কুমিল্লাপাড়া পল্লীমঙ্গলের এই ধুনুচি নাচ।’

এর পাশাপাশি পুজো প্রাঙ্গন প্রশস্ত হওয়ায় এই গুটিকয়েক দিন বেশ একটা মেলার পরিবেশে গড়ে উঠেছে ইতিমধ্যেই। সেখানে মিলছে পকেট ফ্রেন্ডলি নানা ধরনের খাবার দাবারও। সঙ্গে মেলে হরেক রকম জিনিসও। সব মিলিয়ে আড্ডা দেওয়ার মতো বেশ একটা জমাটি আবহ সন্দেহ নেই। এরপর দশমীতে আসে মাকে বিদায় জানানোর পালা। নিরঞ্জন সে অর্থে বিরাট ধুমধাম করে না হলেও একাদশীর দিন মাকে বিদায় জানাতে অংশ নেন কুমিল্লা পাড়ার পল্লীবাসীরাই। মূলত ঢাকের তালে ধুনুচি নাচের মধ্য়ে দিয়ে মাকে নিরঞ্জন দেওয়া হয় গঙ্গায়। সঙ্গে থাকবে সেই পুরনো দিনের ব্য়ান্ড পার্টিও। বিরাট এক শোভাযাত্রার মধ্য়ে দিয়ে মাকে বিদায় জানান কুমিল্লাপাড়ার প্রত্যেকেই। আর সেই মুহূর্ত থেকেই শুরু হয় ফের দিন গোনার পালা, কবে আসবে মা, কবে আসবে তাঁদের ঘরের মেয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

4 × five =