প্রয়াত মনোজ মিত্র। বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। বাংলা থিয়েটার ও চলচ্চিত্র জগতের এই কিংবদন্তি শিল্পী বেশ কিছুদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মঙ্গলবার সকাল ৮.৫০ নাগাদ তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে আশঙ্কাজনক অবস্থায় বর্ষীয়ান অভিনেতা তথা নাট্যকারকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে।সল্টলেকের ক্যালকাটা হার্ট ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট নিয়ে অশীতিপর অভিনেতাকে ভর্তি করানো হয়। শরীরে সোডিয়াম ও পটাশিয়ামের মাত্রা কমে যাওয়ার রক্তচাপ খুবই কমে গিয়েছিল। এর পর তিনি সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। তবে অসুস্থতা পিছু ছাড়েনি। এ বছর একাধিকবার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। বছরের শুরুতেই বুকে প্রেসমেকার বসেছিল তাঁর। হৃদযন্ত্রের সমস্যা–সহ একাধিক অসুস্থতার চিকিৎসা চলছিল৷ শেষ পর্যন্ত হেমন্তের সকালে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে সাজানো বাগান ফেলে চলে গেলেন বাঞ্ছারাম৷তাঁর প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ সামাজিক মাধ্যমে শোকবার্তায় তিনি লিখেছেন, ‘প্রখ্যাত নট, নাট্যকার ও পরিচালক, ‘বঙ্গবিভূষণ’ মনোজ মিত্র’র প্রয়াণে শোকাহত হলাম। বাংলা থিয়েটার ও চলচ্চিত্র জগতে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। তাঁর পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও অনুরাগীদের সমবেদনা জানাই।’
স্কটিশ চার্চ কলেজের দর্শন বিভাগের ছাত্রজীবন৷ ১৯৫৮ সালে যখন দর্শনে স্নাতক হচ্ছেন, তত দিনে তাঁর মনে নাটকের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গিয়েছে৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরের সময় ভূমিষ্ঠ হয়ে গিয়েছে মনোজ মিত্রের নাটকের দল ‘সুন্দরম’৷নাটকের টানেই আর দর্শনের অধ্যাপক হয়ে থাকা হল না৷ হয়ে গেলেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্য বিভাগের অধ্যাপক৷ এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই বিভাগীয় প্রধান ‘শিশিরকুমার ভাদুড়ি’ অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন৷ পরিচালনা, অভিনয়ের মাঝেই কলম থেকে ঝরে পড়েছে ‘সাজানো বাগান’, ‘চোখে আঙুল দাদা’, ‘কালবিহঙ্গ’, ‘পরবাস’, ‘অলকানন্দার পুত্রকন্যা’, ‘নরক গুলজার’, ‘অশ্বত্থামা’, ‘চাকভাঙা মধু’, ‘মেষ ও রাক্ষস’, ‘মুন্নি ও সাত চৌকিদার’, ‘বৃষ্টির ছায়াছবি’, ‘যা নেই ভারতে’-এর মতো মণিমুক্তো৷
নাট্যজগতের এই প্রতিষ্ঠান যখন বাংলা সিনেমায় এসেছেন অভিনেতা হিসেবে, তখন ধরা দিয়েছেন স্বকীয়তায় ভরা নতুন আঙ্গিকেই৷ দীর্ঘ কেরিয়ারে ‘গণশত্রু’, ‘ঘরে বাইরে’, ‘দামু’, ‘শত্রু’-সহ একাধিক ছবি থাকলেও মনোজ মিত্র বাঙালির হৃদমাঝারে থাকবেন বাঞ্ছারাম হয়ে৷ তাঁর নিজের লেখা ‘সাজানো বাগান’ নাটক থেকেই তপন সিনহা বানিয়েছিলেন এই ছবি৷ শুধু এই ছবিতেই নয়, মনোজ সযত্নে রক্ষা করে গিয়েছেন বাংলা অভিনয়ধারার সজীবতাকেই৷ তাঁর অভিনয়ের সহজাত কৌতুকরস সঞ্চারিত হত খলচরিত্রের অভিনয়েও৷ নীচু লয়ে, কেটে কেটে সংলাপ বলার ধরন অনবদ্য এবং অনণুকরণীয়। বাসু চ্যাটার্জি, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত এবং তরুণ মজুমদার সহ বিশিষ্ট পরিচালকদের ছবিতেও অভিনয় করেছেন। তিনি ১০০ টিরও বেশি নাটক লিখেছেন এবং ১৯৮৫ সালে সেরা নাট্যকারের জন্য সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার জিতেছেন।