পালিত হল পশ্চিমবঙ্গ দিবস, তবে তুলে দিয়ে গেল হাজারো প্রশ্ন

কস্মিনকালে আমরা পালন করিনি পশ্চিমবঙ্গ দিবস। সেটা কী তাও আমাদের মধ্যে কজন এখনও জানেন তাও বলতে পারবো না। তবে হঠাৎ-ই গত দু’বছর ধরে ২০ জুনকে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে স্যাফ্রন ব্রিগেডের তরফ থেকে। নানা কর্মসূচিও পালন করতেও দেখা গেছে তাঁদের। ২০২১ সালে বিধানসভা উত্তপ্ত হয়েছিল এই পশ্চিমবঙ্গ দিবসকে কেন্দ্র করে। এদিকে শাসকদল মানে তৃণমূল কোনওভাবেই মানতে নারাজ পশ্চিমবঙ্গ দিবস নিয়ে। তাঁদের তরফ থেকে দাবি করা হয়, এরকম কোনও দিনের ইতিহাস-নির্ভরতা নেই। পাল্টা বিজেপির দাবি, ইতিহাসকে মুছতেই শাসকদল মরিয়া। তাই নিজেদের ‘গৌরব’কে উদযাপন পর্যন্ত করতে চায় না তারা।

এবার রাজভবনে এই ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ উদযাপন ঘিরে এবার জোর তরজা বাধে রাজ্যের সঙ্গে রাজভবনের। সোমবার রাজ্যপালকে চিঠি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুরোধ করেন, রাজভবনে যেন এমন কোনও দিন উদযাপন না করা হয়। কানাঘুষো শোনাও গিয়েছিল রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস নাকি তা মেনেও নিয়েছেন। অথচ মঙ্গলবার এক্কেবারে উল্টো ছবি। সকাল থেকে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান চলল রাজভবনে। তাতে অংশ নেন রাজ্যপাল। উপস্থিত থাকতে দেখা যায় বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকেও। যদিও রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের বক্তব্য, রাষ্ট্রপতির নির্দেশেই এই দিনটি পালন করছেন তিনি।

আমরা যাঁরা পশ্চিমবঙ্গ দিবস সম্পর্কে কোনও খোঁজ রাখি না তাঁদের এবার তো উচিত একটু এই দিনটা সম্পর্কে জানা। আপাতত যেটুকু ইতিহাস ঘেঁটে জানা যাচ্ছে তাতে ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় আইন পরিষদে (অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক আইনসভা) অখণ্ড বাংলা ভাগের বিষয়টি উত্থাপিত হয়। আর এই বাংলা ভাগের পক্ষে বড় অংশের ভোট পড়ায় দু’টুকরো হয় বাংলা। এই ভোটাভুটির ফলাফলের ভিত্তিতেই পশ্চিমবাংলা ভারতের অংশ হয় এবং অপর ভাগটি পরিচিত হয় পূর্ব বাংলা নামে। যা প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ ছিল  এবং পরে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ হয় যুক্ত হয় পাকিস্তানের সঙ্গে। এই বাংলা ভাগের দু’মাসের মাথায় ইংরেজদের পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হয় ভারত। ২০ জুনের সেই সিদ্ধান্তকে সামনে রেখেই পশ্চিমবঙ্গ দিবসের দাবি তোলা হয় বিজেপির তরফ থেকে। পাল্টা তৃণমূলের দাবি, বঙ্গ বিভাজনের যন্ত্রণা বাঙালিকে আজও তাড়া করে। আর এই কারণেই পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনে মোটেই সম্মতি ছিল না তাদের।

এদিকে সোমবারই রাজ্যপালকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে চিঠি লিখেছিলেন, তাতে উল্লেখ করেন, এমন দিবস কোনওদিন এ রাজ্যে পালিত হয়নি। ইতিহাস এরকম কোনও উদযাপনকে সমর্থনও করে না। মমতা লিখেছেন, বাংলা ভাগ লক্ষ লক্ষ মানুষের যন্ত্রণার, ভয়াবহ অভিজ্ঞতার সাক্ষী। এই উদযাপন তাঁদের ভাবাবেগে আঘাতের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিদ্বেষে ইন্ধন দেয়। রাজভবনের এই ‘এক তরফা’ সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক বলেও চিঠিতে লিখেছিলেন মমতা। আর্জি জানিয়েছিলেন, এই প্রতিষ্ঠা দিবস পালন বন্ধ রাখতে। টুইটারে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীও লেখেন, ‘ইতিহাস বিকৃতির মনোভাবেই বিজেপির রাজনীতি। পশ্চিমবঙ্গ দিবস উদযাপন-এর নামেও একই প্রচেষ্টা। লর্ড কার্জনের ‘বঙ্গভঙ্গ’-র চক্রান্তকে ঠেকাতে পেরে গর্বিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ’রা। দেশভাগের বিপর্যয়ে বাংলাকে ভাগ করার কৃতিত্ব নিয়ে গর্ব করেছেন শ্যামাপ্রসাদ’রা। কী দুর্ভাগ্য বাংলার!’ আর অধীরঞ্জন তো প্রশ্ন তুলেই দিলেন, পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালনের কারণ কী তা নিয়ে? জানতে চাইলেন, ‘আজকের দিনে পশ্চিমবঙ্গে হাতি ঘোড়া বাঘ ভাল্লুক কী হয়েছে? আমরা কী এই দিন স্বাধীন হয়েছিলাম? আমি স্বাধীনতা দিবস জানি, প্রজাতন্ত্র দিবস জানি, পশ্চিমবঙ্গ দিবস জানি না।‘

এদিকে মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গ দিবসে শুভেন্দু অধিকারী একটি টুইটে লেখেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী সকল মানুষের জন্যেই ২০ জুনের তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে আজকের এই দিনেই শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে বাংলার আইনসভা আমাদের এই রাজ্যকে ভারতবর্ষের অঙ্গরাজ্য হিসাবে নির্ধারিত করার সপক্ষে রায় দিয়েছিলেন। সৃষ্টি হয়েছিল বাঙালি হিন্দুর একমাত্র স্বভূমি অথবা হোমল্যান্ড পশ্চিমবঙ্গের। পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের এই অবদান কোনওদিনও ভোলা সম্ভব নয়। ওনার প্রচেষ্টার কারণে সৌভাগ্যক্রমে আজ আমরা, বিশেষত বাঙালি হিন্দুরা এই মহান দেশ ভারতবর্ষের নাগরিক হওয়ার সম্মান পেয়েছি এবং মাথা উঁচু করে সসম্মানে বেঁচে আছি। যাঁরা এই ইতিহাস কে বিকৃত করে, অথবা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অবদানকে অস্বীকার করে, তাদের চেতনা জাগ্রত হোক এই কামনা করি।’

শুভেন্দুর পাশাপাশি এদিনের এই অনুষ্ঠান থেকে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস জানান,  ‘‌রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং বিবেকানন্দ বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের জন্য তাঁদের অবদান দিয়েছেন। আমি আজকের দিনে বাংলার নাগরিকদের এই দিনের শুভেচ্ছা জানাই। রাষ্ট্রপতি বার্তা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের দিবস পালন করা হচ্ছে। রাজ্যের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে শান্তি এবং সম্প্রীতি বজায় রেখে বাংলার প্রতিষ্ঠা উজ্জ্বল করেছেন। আমি বাংলার মানুষকে স্যালুট জানাই। দেশের ঐক্য এবং উন্নয়নে বাংলার অবদান গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা এখন উন্নতির পথে। বাংলার সাফল্য ভারত সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বাংলা তৈরি করেছে জাতীয় সঙ্গীত। বাংলায় অশান্তির জায়গায় নেই। হিংসার জন্য জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করতে হবে। আমাদের সংবিধান আমাদের ন্যায় বিচারের অধিকার দিয়েছে।’

তবে পশ্চিমবঙ্গ দিবসের ইতিহাস জানার পর কী সব বাঙালি মেনে নিতে পারবেন এই দিনটিকে। কারণ, এই দিনের পরই পূর্ববঙ্গ থেকে অনেককেই ভিটে-মাটি ছেড়ে চলে আসতে হয় পশ্চিমবঙ্গে। তাঁদের কাছে এই দিনটা সুখের না দুঃখের তা কি জানেন স্যাফ্রন ব্রিগেডের নেতারা? জিজ্ঞাসা চিহ্ন কোথায় একটা রয়েই গেল।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

16 − two =